শত শত আইরিশ শিশুর গোপন গণকবরে শায়িত থাকার মর্মান্তিক ইতিহাস
সমাজকাল
প্রকাশ: ২০:৪০, ১৩ জুলাই ২০২৫

শত শত আইরিশ শিশুর গোপন গণকবরে শায়িত থাকার মর্মান্তিক ইতিহাস। আয়ারল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলের গলওয়ে কাউন্টির টুয়ামের ‘সেন্ট মেরি’ নামের শিশুদের হোমে কয়েক শ’ আইরিশ শিশুর গোপন গণকবর থাকার কথা ধারণা করা হয়ে থাকে। ‘ওই শিশুরা যেন ছিল পথের ধুলা’। গণকবরের সন্ধানে হোমটির জমিতে আনুষ্ঠানিক খনন কাজ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই।
সমাজকাল ডেস্ক
কোনো কবরের রেকর্ড নেই। নেই কোনো শিলালিপি, কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। ২০১৪ সালে, যখন এক শৌখিন ইতিহাসবিদ আবিষ্কার করেন যে, আয়ারল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলের গলওয়ে কাউন্টির টুয়ামের একটি পুরনো স্যুয়ারেজ ট্যাংকে হয়তো শত শত শিশুর লাশ সমাহিত রয়েছে।
এই ঘটনার ১১ বছর পর, সেই নির্জন ঘাসে ঢাকা জমিতে খননযন্ত্রের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। সোমবার (১৪ জুলাই) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে খনন কাজ শুরু হচ্ছে। দুই বছর ধরে চলবে এই খনন।
এই জায়গাতেই একসময় ছিল ‘সেন্ট মেরি’ নামের শিশুদের জন্য নির্মিত একটি হোম, যা ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার নারী ও শিশুকে আশ্রয় দিয়েছিল। এর অধিকাংশই ছিল অবিবাহিত অন্তঃসত্ত্বা নারী, যাদের পরিবার ত্যাগ করেছিল, এবং সন্তান জন্মের পর শিশুদের আলাদা করে ফেলা হতো।
সেন্ট মেরিতে প্রথম যে শিশুটি মারা যায় তার নাম ছিল প্যাট্রিক ডেরেইন – বয়স মাত্র পাঁচ মাস। সর্বশেষ মৃত্যুর ঘটনা ১৯৬০ সালে, মৃত শিশুটির নাম ছিল মেরি কার্টি। এ দুই মৃত্যুর মাঝখানে আরও ৭৯৪টি শিশুর মৃত্যু ঘটে – যাদের অনেকেরই দেহাবশেষ ওই “ভয়ের কুঠুরি”তে সমাহিত রয়েছে বলে মনে করা হয়, যেভাবে একে আখ্যায়িত করেছিলেন আয়ারল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এন্ডা কেনি।
“আমি সেখানে বন্দিজীবন কাটিয়েছি” – পিজে হ্যাভার্টি
সেই হোমে নিজের শৈশব কাটানো পিজে হ্যাভার্টি বলেন, “আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি – আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।” তিনি স্মরণ করেন, কীভাবে ওই ‘হোম চিলড্রেন’ নামকরা শিশুরা সমাজে বঞ্চনার শিকার হতো। স্কুলে যেতে হতো দেরিতে, ছুটতে হতো আগে – অন্য শিশুদের সঙ্গে কথা না বলার জন্য। “আমরা ছিলাম যেন পথের ধুলা।”
গোপন কবর আবিষ্কারের গল্প: ক্যাথরিন করলিসের অনুসন্ধান
২০০৫ সালে স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে কোর্স করতে গিয়ে ক্যাথরিন করলিসের কৌতূহল জন্মায়। তিনি বিস্মিত হন, কেন তার সহজ জিজ্ঞাসার জবাবে সবাই চুপ – কেউ সহযোগিতা করছিল না, কোনো রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছিল না। একদিন এক কবরস্থানের কর্মচারী তাকে নিয়ে যান সেই হাউজিং এস্টেটে, যেখানে এক সময় শিশুদের হোমটি ছিল। শিশুরা খেলতে গিয়ে ১৯৭০-এর দশকে একটি ভাঙা কংক্রিটের স্ল্যাবের নিচে হাড়গোড় দেখতে পায়।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল সেগুলো ১৮৪০-এর দশকের দুর্ভিক্ষকালের মৃতদেহ। কিন্তু ক্যাথরিন জানতেন, দুর্ভিক্ষের শিকারদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল শহরের বাইরে অন্য স্থানে। তিনি পরবর্তী সময়ে সরকারের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ে ফোন করে জানতে চান, হোমে মৃত সব শিশুদের নাম। দুই সপ্তাহ পর জানতে পারেন সংখ্যাটা বিশাল – মোট ৭৯৬টি শিশু। কিন্তু কোথাও তাদের দাফনের রেকর্ড নেই। একটি পুরনো ম্যাপে উল্লেখ ছিল, সেই জায়গাটিতে ছিল একটি ‘স্যুয়ারেজ ট্যাংক’। ক্যাথরিন বিশ্বাস করতে থাকেন – হয়তো এখানেই রয়েছে শিশুদের গণকবর।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: মেরি মোরিয়ার্টির চোখে দেখা বিভীষিকা
১৯৭০-এর দশকে ঐ জায়গার পাশেই বাড়িতে থাকতেন মেরি মোরিয়ার্টি। তিনি বলেন, একবার বালক একটি মাথার খুলি হাতে পেয়েছিল। অনুসন্ধানে গিয়ে মেরি নিজেই একটি গর্তে পড়ে যান এবং দেখতে পান সারি সারি কাপড়ে মোড়া “ছোট ছোট গাঁটরি” – ছাঁচে ভরা, গন্ধযুক্ত, সারিবদ্ধভাবে রাখা।“সেগুলো শিশু ছিল,” তিনি বলেন।
মায়ের হারানো সন্তানদের সন্ধানে: আনা করিগান
২০১২ সালে আনা করিগান খুঁজে পান তার মা টুয়ামে দুই পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েছিলেন – জন (১৯৪৬) এবং উইলিয়াম (১৯৫০)। জনের মৃত্যুর রেকর্ডে লেখা ছিল “congenital idiot” এবং “measles”।
তিনি বলেন, “জন্মের সময় সে ছিল সুস্থ, ৯ পাউন্ড ওজনের। ১৩ মাস বয়সে সে ক্ষীণকায়, দুর্বল, শারীরিক নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায়। তারপর মারা যায়।” কিন্তু উইলিয়ামের কোনো মৃত্যুর রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
সরকারি তদন্ত ও খনন কাজ
২০১৭ সালে আয়ারল্যান্ড সরকার তদন্তে নিশ্চিত করে, ওই জায়গায় “ব্যাপক মানবাবশেষ” পাওয়া গেছে। সেগুলোর বয়স ছিল ৩৫ সপ্তাহের ভ্রূণ থেকে ২-৩ বছরের শিশু পর্যন্ত।
এখন, দুই বছরের দীর্ঘ এক খনন শুরু হয়েছে – যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অনুসন্ধানী ড্যানিয়েল ম্যাকসুইনি। তিনি বলেন, শিশুদের হাড়গোড় “চরমভাবে ক্ষুদ্র” এবং সতর্কতার সঙ্গে খনন ছাড়া পরিচয় শনাক্ত করা অসম্ভব।
সেই নামহীন শিশুরা এখন আর নেই। কিন্তু তাদের কাহিনি, তাদের দুঃখ, আজ উঠে এসেছে আলোয়। যারা হারিয়ে ফেলেছিলেন তাদের ভাই, বোন বা সন্তান – তারা অপেক্ষা করছেন, একফোঁটা সত্যের আশায়। এই নির্জন ঘাসের নিচে চাপা পড়ে থাকা ইতিহাস, এখন নিজে থেকে কথা বলছে।