স্বাস্থ্যসেবার প্রথম শর্ত রোগীর সুরক্ষা
মুবাশ্বির ইসলাম মারুফ
প্রকাশ: ০৯:৫৫, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো স্বাস্থ্য। অসুস্থ হলে মানুষ আশ্রয় নেয় চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর। কিন্তু চিকিৎসার সময় যদি রোগী নিজেই সুরক্ষাহীন হয়ে পড়ে, তবে সেটি হয়ে দাঁড়ায় এক গভীর মানবিক বিপর্যয়। রোগীর সুরক্ষা স্বাস্থ্যসেবার প্রথম শর্ত। এই গুরুত্ব অনুধাবন করেই প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব রোগী সুরক্ষা দিবস’। দিবসটির লক্ষ্য হলো রোগী সুরক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া, স্বাস্থ্যসেবায় ঝুঁকি কমানো এবং চিকিৎসার প্রতিটি ধাপে মানবিকতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা। এ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘প্রত্যেক নবজাতক এবং প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ যত্ন’।
এই দিবসের সূচনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০১৯ সালে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি যতই হোক, পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে নতুন জটিলতায় পড়েন। ভুল চিকিৎসা, ওষুধের অনিয়ম, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা কিংবা অবহেলার কারণে অসংখ্য রোগী অকালেই মৃত্যুবরণ করেন বা আজীবন ভোগেন নানা জটিলতায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শুধু চিকিৎসা-সম্পর্কিত ত্রুটির কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। অথচ এর একটি বড় অংশই প্রতিরোধযোগ্য। যদি চিকিৎসা প্রদানের প্রতিটি ধাপে যথাযথ সতর্কতা ও সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তবে বহু মানুষের জীবন রক্ষা সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোগী সুরক্ষার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার ঘনত্ব, স্বাস্থ্যসেবার সীমিত অবকাঠামো, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট, ওষুধের অনিয়মিত ব্যবহার, সব মিলিয়ে রোগীরা প্রায়ই অনিরাপদ পরিস্থিতির শিকার হন। অনেক সময় রোগীর প্রতি উদাসীনতা, হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি কিংবা যথাযথ নজরদারির অভাব রোগী সুরক্ষাকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট, ওষুধের অপ্রাপ্যতা এবং জনবল ঘাটতির কারণে রোগীরা অবহেলার শিকার হন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও উচ্চ খরচ, মানহীন সেবা ও অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণের কারণে রোগী সুরক্ষার প্রশ্নটি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়।
রোগীর প্রতি সামান্য অবহেলা শুধু একজন ব্যক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং একটি পরিবারকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চিকিৎসকদের নৈতিক দায়িত্ব, স্বাস্থ্যব্যবস্থার অঙ্গীকার এবং রাষ্ট্রেরও সাংবিধানিক দায়িত্ব।
এক্ষেত্রে কিছু মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। প্রথমত, চিকিৎসকদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত আপডেটেড জ্ঞান নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিবর্তন আসছে, তাই চিকিৎসকদের আধুনিক চিকিৎসা প্রটোকলের সঙ্গে পরিচিত থাকা অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, ওষুধ ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। ভেজাল ওষুধ কিংবা ভুল প্রেসক্রিপশন রোগী সুরক্ষার জন্য ভয়াবহ হুমকি। তৃতীয়ত, হাসপাতাল ও ক্লিনিকের পরিবেশকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখা প্রয়োজন। সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা, জীবাণুনাশক ব্যবহার, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থত, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত করা দরকার। রোগীর প্রতি সহমর্মিতা চিকিৎসার অঙ্গ, যা রোগীর মানসিক স্বস্তি এনে তার আরোগ্যকে ত্বরান্বিত করে।
রোগী সুরক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা, ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন, টেলিমেডিসিন ইত্যাদির মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে আরও নিরাপদ ও স্বচ্ছ করা সম্ভব। বিশেষ করে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করা কঠিন নয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যখাতে জনবল ও বাজেট বাড়ানো, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
এই দিবসে আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যসেবায় ভুল বা অবহেলা একটি বড় সামাজিক অন্যায়। এটি মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। তাই রোগী সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্র, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ জনগণসহ সবার সচেতনতা জরুরি। রোগীর প্রতি সদাচরণ, চিকিৎসার প্রতিটি ধাপে সতর্কতা এবং মানবিক দায়িত্বশীলতাই পারে রোগী সুরক্ষার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে।