‘তিনি কেন রাত ১২টা ৩০-এ বাইরে গেলেন?’
ধর্ষণ নিয়ে মমতার প্রশ্নে তীব্র বিতর্ক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭:২০, ১২ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০০:৪৭, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে এক মেডিকেল শিক্ষার্থীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য ঘিরে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। শনিবার রাতের ওই ভয়াবহ ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী আজ সাংবাদিকদের সামনে প্রশ্ন করেন—“তিনি একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তেন। দায়িত্ব কার? রাত ১২টা ৩০ মিনিটে তিনি কীভাবে বাইরে এলেন?”
এই মন্তব্যের পর থেকেই রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে নারী অধিকারকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘ভিকটিম শেমিং’ বা শিকারীকে দোষারোপের মানসিকতা বলে মন্তব্য করেছেন।
ভারতের ওড়িশার জেলেশ্বরের বাসিন্দা ২৩ বছর বয়সী ওই শিক্ষার্থী দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শুক্রবার রাতে তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে ক্যাম্পাসের বাইরে ঘুরতে বের হন। এ সময় কয়েকজন যুবক তাদের ঘিরে ফেলে এবং জোর করে এক নির্জন এলাকায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।
এরপর অসুস্থ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেয়েটির বাবা সাংবাদিকদের বলেন, “আমার মেয়ে এখন হাঁটতেও পারছে না। আমরা ভয় পাচ্ছি, ওখানে ওর নিরাপত্তা নেই। তাই ওকে ওড়িশায় ফিরিয়ে নিতে চাই।”
ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন,“তিনি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়েন। দায়িত্ব কার? রাত ১২টা ৩০-এ কীভাবে বাইরে গেলেন? কলেজ কর্তৃপক্ষেরই ছাত্রছাত্রীদের সুরক্ষা দিতে হবে। ওটা বনাঞ্চল এলাকা, তাই রাতের ‘কালচার’ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।”
তিনি আরও বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অন্য রাজ্যেও এমন ঘটনা ঘটছে, ওড়িশা ও অন্যান্য রাজ্য সরকারকেও ব্যবস্থা নিতে হবে।”
তবে এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিরোধী বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে “নারী বিদ্বেষী ও হৃদয়হীন” বলে দাবি করেছে।
বিজেপি মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “লজ্জাজনক! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগীকেই দায়ী করলেন। এটি নারীসুলভ মর্যাদার প্রতি অপমান।”
অন্যদিকে বিজেপি নেতা শহজাদ পুনাওয়ালা বলেন, “তিনি সবসময় ‘বেটি’-কে দোষ দেন, আর অপরাধীদের রক্ষা করেন। আরজি কর, সন্দেশখালি, পার্ক স্ট্রিট—সব ক্ষেত্রেই একই আচরণ দেখা গেছে।”
এ ছাড়া কংগ্রেস ও বাম নেতারাও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন এবং বলেছেন, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থাকা কারও কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য “অত্যন্ত দুঃখজনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন”।
ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঞ্জি এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “এটি এক অত্যন্ত নিন্দনীয় ও মর্মান্তিক ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়। আমাদের প্রশাসন ভুক্তভোগী পরিবারকে সবরকম সহায়তা দেবে।”
তিনি জানান, ওই শিক্ষার্থীকে ওড়িশায় ফিরিয়ে এনে স্থানীয় মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। তাদের নাম—আপু বাউরি (২১), ফিরদোস শেখ (২৩) এবং শেখ রিয়াজউদ্দিন (৩১)। এছাড়া মেয়েটির সঙ্গে থাকা পুরুষ বন্ধুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই ঘটনায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। দোষীদের কোনোভাবেই রেহাই দেওয়া হবে না।”
নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য সমাজে ‘রেপ মিথস’ বা ধর্ষণ সংক্রান্ত ভুল ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে।
“একজন নারী কখন, কোথায়, কীভাবে চলবেন—এটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও প্রশাসনের কাজ,” মন্তব্য করেছেন সমাজবিজ্ঞানী ড. সুস্মিতা ঘোষ।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই বক্তব্য শুধু শিকারীর মানসিক আঘাত বাড়ায় না, বরং ভবিষ্যতের ভুক্তভোগীদের সামনে আসতেও নিরুৎসাহিত করে।