নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়নের পরিণতি ঢাকা আজ ‘ঝুঁকির শহর’
হাবীব ইমন
প্রকাশ: ০৮:৪৬, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০৯:০৬, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
ঢাকা আজ শুধু বিশ্বের অন্যতম জনবহুল নগরী নয়, বরং দ্রুত পরিণত হয়েছে একটি উচ্চঝুঁকির শহরে। আকাশছোঁয়া ভবনের সারির আড়ালে লুকিয়ে আছে অজস্র বিপদ, অব্যবস্থাপনা আর মৃত্যুঝুঁকি। রাজধানীর ৭৪ শতাংশ ভবনই নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়নি—বিভিন্ন সংস্থার এমন জরিপ ইতোমধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকদের মধ্যে। কিন্তু রাজউক ও সিটি করপোরেশনের দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তা এবং তদারকির ঘাটতির কারণে পরিস্থিতি দিন দিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
রাজধানীর প্রায় ৮০–৯০ শতাংশ ভবনেই নেই কার্যকর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। পুরান ঢাকা, সুত্রাপুর, লালবাগ, কোতোয়ালি—পুরোনো বসতিপূর্ণ এলাকায় সংকীর্ণ রাস্তা, অনিয়ন্ত্রিত দালান–বাড়ির বিস্তার, এবং দাহ্য রাসায়নিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মিলিয়ে প্রতিদিনই বাসিন্দাদের মাথার ওপরে ঝুলছে মৃত্যুর ঝুঁকি। অথচ এত ঝুঁকির মাঝেও ভবন মালিকরা নিয়মভঙ্গ করে আরও তলা তোলা, নকশা পরিবর্তন বা অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যাপক বিপর্যয়ের শঙ্কা—৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) জানাচ্ছে—২০০৯ সালের সিডিএমপি–জাইকা জরিপ অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রা বা তার বেশি ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে যেতে পারে। আরও ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালিকা পুরোনো, বাস্তব ঝুঁকি আরও অনেক বেশি হতে পারে।
রাজউকের হিসাবেও রাজধানীর চার থেকে ৩০ তলা পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ বহুতল ভবন এখন ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে। প্রয়োজনীয় নীতিমালা মানা হয়নি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা ভবন মাত্র ৩২১টি হলেও মাঠপর্যায়ের পরিকল্পনাবিদদের মতে বাস্তবে সংখ্যা কয়েক হাজার।
ভূমিকম্পে ফাটল—বাসিন্দাদের আতঙ্ক বাড়ছে
গত দুই সপ্তাহে কয়েক দফা ভূমিকম্প রাজধানীবাসীকে নতুন করে আতঙ্কিত করেছে। ২১ নভেম্বরের ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকা, বাড্ডা, মিরপুর থেকে শুরু করে উত্তরা পর্যন্ত বিভিন্ন ভবনে ফাটল দেখা গেছে। কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে, কোথাও জানালা–রেলিং ভেঙে পড়েছে। নিউমার্কেট থানার ভবনেও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। সুত্রাপুর ও কলাবাগানের দুটি ভবন হেলে পড়ার ঘটনাও গুরুতর শঙ্কা তৈরি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে পলেস্তারা খসে পড়েছে। পুরান ঢাকার কেপি ঘোষ স্ট্রিটে পাঁচতলা ভবনের রেলিং ভেঙে পড়ায় পথচারীরা আতঙ্কে ছুটোছুটি করে। এসব ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে—ভূমিকম্পের ঝুঁকি কতটা ঘনিয়ে এসেছে।
অগ্নিনিরাপত্তায় ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৮০–৯০ শতাংশ ভবনে নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত করা পরিদর্শনে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ২,৬০৩টি ভবন। এসবের মধ্যে বিপণিবিতান ৫৮টি; এর মধ্যে ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ, ৯টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
২০২৪ সালের জাতীয় পর্যায়ের পরিদর্শনে আরও পাওয়া যায়—১,১৮১টি বহুতল ভবনের মধ্যে ৭৪টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩৬৭টি মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে। অধিকাংশ ভবনেই দেখা গেছে সিঁড়ির জায়গা দখল, জরুরি বহির্গমন পথ নেই, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পুরোনো বা অকেজো—এমন অগণিত অনিয়ম
রাজউকের নির্দেশনা—কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ
রাজউক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করছে ঠিকই, কিন্তু ভাঙা বা সংস্কার করা হচ্ছে খুবই কম। গত ১০ বছরে যে সংখ্যক ভবন ভাঙার নোটিশ দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে তার এক-চতুর্থাংশও ভাঙা হয়নি।
এর মধ্যে কবি নজরুল কলেজের ছয়তলা ভবন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ভবন, পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজের পাশের ভবন—সবই দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প’–এর আওতায় ২১টি প্রতিষ্ঠানের ৩০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হলেও তালিকা হালনাগাদ করা ছাড়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
রাজউক ভবন মালিকদেরই দায়ী করছে
রাজউক চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন—“আমরা নিয়ম মেনেই অনুমোদন দিই। ভবন মালিকরা নকশা জমা দেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে। পরে যদি নিয়ম ভাঙেন, তার দায় তাদেরই।”
তিনি আরও বলেন, ঢাকা অঞ্চলে ছোট–বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০টি ভবন এখন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এখনো রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ভয়াবহ। ভবনের নকশা অনুমোদনে দুর্নীতি, নিয়মভঙ্গের পরও কোনো নজরদারি না থাকা—এসবই বিপর্যয়ের মূল কারণ।
বিশেষজ্ঞদের কঠোর সতর্কতা
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন—“ভূমিকম্প প্রতিরোধ সম্ভব নয়, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এর জন্য কঠোরভাবে বিল্ডিং কোড ও নির্মাণ বিধিমালা মানা, সিসমিক মাইক্রো জোনেশন ম্যাপ অনুসারে নগরায়ন করা জরুরি। জলাধার–জলাভূমি ভরাট করে কোনো উন্নয়ন চলতে দেওয়া যাবে না।”
তিনি মনে করেন— স্বল্প আয়ের মানুষের নিরাপদ আবাসন, কমিউনিটি প্রস্তুতি, ড্রিল, প্রশিক্ষণ এবং দুর্নীতিমুক্ত নির্মাণ তদারকি ছাড়া ঢাকাকে নিরাপদ করা সম্ভব নয়।
আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক আকতার মাহমুদ একই মত দেন—“চিলি, হাইতি, তুরস্ক—সব ভূমিকম্প এখন প্রমাণ করে দিয়েছে যে বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন মানেই মৃত্যুর ঝুঁকি। ভবন মালিক, প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট সংস্থা—সবাইকে দায়বদ্ধ করতে হবে।”
ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা
নগর পরিকল্পনাবিদরা সতর্ক করছেন—যদি এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে শক্তিশালী ভূমিকম্প বা বড় অগ্নিকাণ্ডে ঢাকা মারণফাঁদে পরিণত হতে পারে। হাসপাতাল, স্কুল, বাজার, অফিস—যেখানে জনসমাগম বেশি—এসব ভবন দ্রুত মূল্যায়ন না করলে ব্যাপক প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
দশকের পর দশক ধরে চলা অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার ফল আজ ঢাকার এই সংকট। এখনই কঠোর উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে।
