লকডাউনের পর শাটডাউন, ফের উদ্বেগ উৎকন্ঠা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩:৫৫, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগি সংগঠনগুলো দুদিনের শাটডাউন কর্মসূচিতে সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত
আগামীকাল সোমবার (১৭ নভেম্বর) ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়। সেই রায়কে কেন্দ্র করে আজ রবিবার (১৬ নভেম্বর) ও আগামীকাল সোমবার কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগি সংগঠনগুলো দুদিনের শাটডাউন কর্মসূচি দিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই অনলাইনে এই কর্মসূচির প্রচারণা চালাচ্ছেন নেতা-কর্মীরা।
এর আগে গত ১৩ নভেম্বর এই রায় ঘোষণার তারিখের দিন ধার্য ছিল। সেদিনকে কেন্দ্র করেও ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি পালন করে দলটি।
লকডাউন কর্মসূচির মতো শাটডাউন কর্মসূচিকে ঘিরেও এক ধরণের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে মানুষের মধ্যে। এর আগে লকডাউন কর্মসূচিকে ঘিরে শুরু হওয়া একই ধরণের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত আছে চলমান শাটডাউন কর্মসূচিতেতেও।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নানা শঙ্কা কাজ করছে মানুষের মধ্যে। সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া রাতে মানুষ বের হচ্ছে না। দিনেও চলাচল করছে আতঙ্ক নিয়ে। হঠাৎ হঠাৎ ককটেল বিষ্ফোরণ হচ্ছে। বাসে অগ্নি সংযোগ হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নামে ঝটিকা মিছিল হচ্ছে।
রাজধানীসহ সারাদেশে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানী ও এর আশেপাশে নাশকতার অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষ করে আগামীকাল শেখ হাসিনার মামলার রায়কে ঘিরে দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা কাজ কাজ করছে। কি রায় হয় এবং রায়কে ঘিরে কি ধরণের অরাজকতা তৈরি হয়, সে নিয়ে আতঙ্কিত মানুষ। রাস্তাঘাটে মানুষকে বলতে শোনা যাচ্ছে, তারা আজ সন্ধ্যার পর ও আগামীকাল ঘরের বাহির হবেন না। যাবতীয় কাজ তারা আজ সন্ধ্যার মধ্যেই সেরে ফেলতে চান।
অবশ্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
শনিবার (১৫ নভেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে পটুয়াখালী সার্কিট হাউসের সামনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী থাকায় কোনো সমস্যা দেখছি না।”
বোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার আশঙ্কায় রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। রায়ের দিন ১৫ হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নগরীর সব স্থানে তৎপর থাকবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চারপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এর আগে গত ১০ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এ সময় নগরীতে কিছু বোমার বিস্ফোরণ ঘটে এবং ১০টি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে এসব ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে।
একইভাবে শাটডাউন কর্মসূচিকে ঘিরেও শুরু হয়েছে নানা ধরণের অরাজকতা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিনিবাসে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শনিবার সকালের দিকে শিমরাইল এলাকায় সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। শনিবার থেকে ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা:
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের ডাকা ‘শাটডাউন’ কর্মসূচিকে ঘিরে আবারো নগরীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এর আগে গত ১৩ নভেম্বর লকডাউন কর্মসূচির সময়ও কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। এবারো একই ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঢাকাজুড়ে তাদের তৎপরতা শুরু করেছে।
রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে আবারো চেকপোস্ট বসিয়ে সব ধরনের যানবাহনে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছে। ডিএমপির বিভিন্ন থানা-পুলিশের অধীনে নগরীর শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, বাবুবাজার ব্রিজ এলাকা, গাবতলী, আব্দুল্লাহপুর এবং ডেমরা সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি অভিযান চালানো হচ্ছে। ঢাকা জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে আমিনবাজার এলাকাতেও চেকপোস্ট বসিয়ে চলেছে তল্লাশি কার্যক্রম। নিরাপত্তাকর্মীরা সড়ক-মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে গাড়ি থামিয়ে মোটরসাইকেল, বাস, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারের যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গন্তব্য ও আগমনের কারণ জানতে চাওয়া হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি মিডিয়া তালেবুর রহমান জানান, তল্লাশি কার্যক্রমের পাশাপাশি নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে সব থানা এলাকায় পুলিশের টহল কার্যক্রম আরো জোরদার করা হয়েছে। আগামী ১৭ নভেম্বর বিকাল পর্যন্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা কঠোর থাকবে। এছাড়া কেউ যেন বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে সেই লক্ষ্য রাখতেও পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকা ব্যাগপত্র ও মালামাল তল্লাশি করা হচ্ছে।
পুলিশ জানায়, এর আগে গত ১০ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ এবং ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণার পর বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে- যা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এবার শাটডাউন কর্মসূচির সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক না। সুযোগ পেলে নেতাকর্মীরা ১৭ নভেম্বর ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করতে পারে। সন্দেহভাজন নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারের লক্ষে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে রাজপথে নামার চেষ্টা করবে। তাদের এই সুযোগ দেয়া হবে না।
কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ডাকে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত অন্তত চার জেলায় ‘বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ’ কর্মসূচি হয়েছে। এসব স্থান থেকে আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পিরোজপুরে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে, কিশোরগঞ্জে জিয়া পরিষদে অগ্নিসংযোগ এবং ফরিদপুরে গ্রামীণ ব্যাংকে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর হাতিরঝিল, মিরপুর, আগারগাঁও ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। হাতিরঝিলে ককটেল হামলায় মোটরসাইকেলে আগুন ধরে যায়। এ নিয়ে গত ছয় দিনে পুড়ল ৩২ যানবাহন।
গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ও বাস চলাচল বন্ধ:
চলমান পরিস্থিতিতে যে কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (গোবিপ্রবি) রবি ও সোমবারের সকল পরীক্ষা এবং বাস চলাচল সর্বসম্মতিক্রমে বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শনিবার (১৫ নভেম্বর) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক সহযোগী অধ্যাপক মো. আব্দুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আদিষ্ট হয়ে জানানো যাচ্ছে যে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উপদেষ্টার দপ্তর, প্রক্টোরিয়াল দপ্তর, বিভাগের শিক্ষার্থী উপদেষ্টা, পরিবহন প্রশাসক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে শনিবার (১৫ নভেম্বর) রাত ৯টায় অনলাইনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রবিবার ও সোমবার (১৬ ও ১৭ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় যথারীতি খোলা থাকবে। ক্লাসের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সভাপতি ও ডিন মহোদয়গণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। প্রয়োজনে অনলাইনে জুম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। রবি ও সোমবারের পরীক্ষাসমূহ শুক্র ও শনিবার নেওয়া যেতে পারে।
এছাড়া রবিবার পরিবহন সেবা বন্ধ থাকবে মর্মে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
বাস চালাবেন না অনেক মালিক:
পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন, শাটডাউন কর্মসূচির সময় নাশকতার আশঙ্কায় অনেকেই তাদের বাস রাস্তায় নামাবেন না। তবে কয়েকজন পরিবহন নেতা জানিয়েছেন, তারা ১৭ তারিখ বাস চালাবেন। তবে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর এড়াতে এসময় বাসমালিকদেরকে বাস-মিনিবাস কোনো প্রধান সড়কের পাশে দীর্ঘ সময় পাকিং না করানোর পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ।
