কবিরা নিজে নিজে সৃষ্টি হয়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬:৪২, ৫ নভেম্বর ২০২৫
ছবি: জাতীয় কবিতা পরিষদ
`কবিকে কেউ সৃষ্টি করতে পারে না, কবিরা নিজে নিজে সৃষ্টি হয়’— এমন গভীর দার্শনিক উচ্চারণে অনুরণিত হয়েছিল জাতীয় কবিতা পরিষদের নিয়মিত কবিতাপাঠ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের ৫৩তম আয়োজন।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় রাজধানীর ২৬ ইস্কাটন গার্ডেন রোডের কাজল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সাহিত্যসভায় প্রধান আলোচক ছিলেন কবি, লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক মাহমুদ শফিক।
সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহন রায়হান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সত্তরের দশকের বিশিষ্ট কবি ও জাতীয় কবিতা পরিষদের উপদেষ্টা সদস্য মতিন বৈরাগী।
দিনটির আলোচ্য বিষয় ছিল ‘কবিতা : ভিতরে বাইরে’। মূল প্রবন্ধ পাঠে কবি মাহমুদ শফিক বলেন—‘কবিতা কোনো বাহ্যিক চাপে সৃষ্টি হয় না; কবিরা নিজেরাই সৃষ্টি করেন কবিতা, তাই কবিরাই স্রষ্টা।’
তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে এমন এক চৈতন্যশক্তি আছে, যা তাকে মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে। কবিতা সেই চেতনারই সৃজন। পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে এমন চিন্তাগত মহত্ত্ব সম্ভব নয়। তাই কবিরা সমাজের আলোকবর্তিকা— যাঁরা নিজেদের ভেতরের আলো দিয়ে সময়, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করেন।
রাজনীতি প্রসঙ্গেও তিনি বলেন, ‘এরশাদ পতন হোক বা আওয়ামী লীগ পতন— এসবই রাজনৈতিক বিবর্তনের ফল, কারও ইচ্ছা নয়।’ তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, আজকের আলোচনার লক্ষ্য রাজনীতি নয়, বরং কবিতার ভিতর-বাহিরের অন্বেষা।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কবি মতিন বৈরাগী বলেন, ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ এখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সভাপতি মোহন রায়হানের নেতৃত্বে এই পরিষদ নিয়মিত ও সুচিন্তিত আয়োজনের মাধ্যমে কবিতা আন্দোলনকে নব উদ্যমে জাগিয়ে তুলেছে।’
তিনি আরও স্মৃতিচারণ করেন— ‘আজকের আলোচক মাহমুদ শফিক আমার অনেক পুরোনো পরিচিত। তাঁর ও মোহন রায়হানের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, তা আজকের সাহিত্যাঙ্গনের জন্য অনুকরণীয়।’
সভাপতির বক্তব্যে কবি মোহন রায়হান তার প্রিয় সহযোদ্ধা মাহমুদ শফিককে স্মরণ করেন অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায়।
তিনি বলেন, ‘মাহমুদ শফিক আমার বন্ধু, সহযোদ্ধা ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক। স্বাধীনতার পর ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র চীফ রিপোর্টার হিসেবে তিনি যেমন সাংবাদিকতায় সত্যনিষ্ঠ ছিলেন, তেমনি কবিতায়ও ছিলেন নির্মোহ ও সাহসী। শাসক-শোষকের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে তিনি সত্যের পক্ষে কলম ধরেছেন।’
রায়হান আরও যোগ করেন, ‘তার কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও শব্দচয়ন এক কথায় অনন্য। বাংলাসাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের ওপরও তার গভীর পাণ্ডিত্য রয়েছে।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রজন্মের পঞ্চাশাধিক কবি। স্বরচিত কবিতাপাঠে অংশ নেন কবি মতিন বৈরাগী, মাহমুদ শফিক, মোহন রায়হান, এবিএম সোহেল রশিদ, নূরুন্নবী সোহেল, আসাদ কাজল, ক্যামেলিয়া আহমেদ, ইউসুফ রেজা, মনিরুজ্জামান রোহান, শিমুল পারভীন, নিপু মল্লিক, জামিল জাহাঙ্গীর, কৌমুদী নার্গিস, টিমুনী খান রীনো, তাসকিনা ইয়াসমিন, গাজী আব্দুল আলীম, এস. এস. রুশদী, কাব্য রাসেল, মিঠু কবির, রাসেল আহম্মেদ, নীপা চৌধুরী, আতিকুজ্জামান খান, হানিফ রাশেদীন, শরীফ খান দীপ ও প্রভাবতী চক্রবর্তী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন কবি মনিরুজ্জামান রোহান, কাব্য রাসেল ও তাসকিনা ইয়াসমিন। সঞ্চালকদের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কবিতার সৌরভ, সৃজনের দীপ্তি ও সাহিত্যের উজ্জ্বল মানবিক চেতনা।
জাতীয় কবিতা পরিষদের এই আয়োজন আবারও প্রমাণ করল— কবিতা কেবল শব্দের খেলা নয়, এটি সমাজের অন্তর্লীন আত্মার প্রকাশ। কবি মাহমুদ শফিকের ভাষায়, ‘কবিকে কেউ সৃষ্টি করতে পারে না, কবিরা নিজে নিজে সৃষ্টি হয়।’
এই কথাটিই যেন দিনের আলোচনার সারমর্ম— কবি ও কবিতা, দুটোই আত্মসৃষ্ট এক বিস্ময়, যা সময় ও সমাজের সীমা ছাড়িয়ে অনন্তের সঙ্গে সংলাপে থাকে।
