সৌদি গ্র্যান্ড মুফতির বর্ণাঢ্য জীবন
মাইসারা জান্নাত
প্রকাশ: ২১:০৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২৩:৫৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ আজ (২৩ সেপ্টেম্বর) ইন্তেকাল করেছেন। তিনি আধুনিক সৌদি আরবের অন্যতম প্রভাবশালী আলেম ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘হাইআতু কিবারিল ওলামা’-এর সভাপতি। তার জীবনের শেকড় নিহিত আছে আরবের বিখ্যাত আলেম পরিবার ‘আলে শায়খ’-এ, যারা দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। এই পরিবারই মহান দাঈ ইমাম মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের উত্তরসূরি।
১৯৪৩ সালে রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন শায়খ আবদুল আজিজ আলে শায়খ। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। জন্ম থেকেই দৃষ্টিশক্তি দুর্বল ছিল। আর মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ দৃষ্টি হারান। দৃষ্টিহীন হয়েও তিনি নিরলস সাধনায় হয়ে ওঠেন সমসাময়িক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম। তিনি চার সন্তানের জনক।
অল্প বয়সেই কোরআন শিক্ষা শুরু করেন এবং মাত্র ১২ বছর বয়সে পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণ মুখস্থ করেন শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ। এর পর তিনি ইমাম দাওয়াহতে ভর্তি হয়ে ইসলামি জ্ঞানচর্চা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ইমাম মুহাম্মদ বিন সৌদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়াহ বিভাগ থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সৌদি আরবের শীর্ষ আলেমদের মজলিসে অংশ নেন। যেমন শায়খ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আলে শায়খ এবং শায়খ আবদুল আজিজ বিন বাযের মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে নিজেকে গড়ে তোলেন।
শিক্ষাজীবন শেষে শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ শিক্ষকতা শুরু করেন। ইমাম দাওয়াহতে এবং রিয়াদের শরিয়াহ কলেজে তিনি দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার্থীদের থিসিস তত্ত্বাবধান, বৈজ্ঞানিক আলোচনা ও গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছেন। এ সময়ে তিনি রেডিওতে ‘নুর আলা দারব’ নামক প্রশ্নোত্তরমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে দিকনির্দেশনা দিতেন, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খের ইমামতি ও খুতবার ইতিহাসও দীর্ঘ। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি রিয়াদের বিভিন্ন মসজিদে খুতবা প্রদান করেন। ১৯৮২ সাল থেকে আরাফাতের ঐতিহাসিক মসজিদে নামিরায় হজের খুতবা দেওয়ার দায়িত্বও পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রিয়াদের কেন্দ্রীয় মসজিদ ইমাম তুরকিতে ইমামতি করেন, যেখানে নিয়মিতভাবে দরস পরিচালনা করতেন।
ধাপে ধাপে শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খের দায়িত্বের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়।১৯৮৭ সালে তিনি হাইআতু কিবারিল ওলামার সদস্য হন। ১৯৯২ সালে স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত হন এবং ১৯৯৬ সালে গ্র্যান্ড মুফতির ডেপুটি নিযুক্ত হন। অবশেষে ১৯৯৯ সালে শায়খ আবদুল আজিজ বিন বাযের মৃত্যুর পর তিনি সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে নিয়োগ পান এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ কর্মজীবনে শায়খ আলে শায়খ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া দিয়েছেন। তিনি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি। ২০১৫ সালে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে তিনি যুবকদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালুর আহ্বান জানান। তার ভাষায়, ‘এটি দেশের নিরাপত্তা এবং ইসলামের মর্যাদা রক্ষার জন্য অপরিহার্য।’ ২০১৭ সালের উপসাগরীয় সঙ্কটেও তিনি দৃঢ় অবস্থান নেন, যখন কাতার অবরোধের সময় তিনি মুসলিম ঐক্য ও আনুগত্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
শায়খ আবদুল আজিজ আলে শায়খ ছিলেন সৌদি আরবের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম প্রধান আলোকবর্তিকা। দৃষ্টিহীনতা তাকে থামাতে পারেনি, তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠা তাকে বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত ইসলামি ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া শিক্ষা, ফতোয়া ও দাওয়াহের ধারা ইসলামি দুনিয়ার জন্য এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।
সূত্র : আলজাজিরা