হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ও ভারতের বিবৃতি প্রসঙ্গে
প্রকাশ: ১৪:০৩, ১৮ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০১:৪৫, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
মাসুদ রানা
সাধারণভাবে, আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। এটি আমার নীতিগত অবস্থান, যা আমি সমভাবে শত্রু ও মিত্র উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করি।
এ কথা আমি ২০১৩ সালে, যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড-চাওয়া শাহবাগ আন্দোলন-কালে বলেছিলাম, এবং আজও বলছি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড প্রসঙ্গে।
তখন, আমাকে কেউ-কেউ “রাজাকারের দোসর” বলেছিলেন, এবং আজ হয়তো কেউ-কেউ আমায় “আওয়ামী লীগের দোসর” বলবেন। অবশ্য, তাতে আমি বিব্রত কিংবা বিচলিত নই।
মানুষ-হত্যা যদি অপরাধ হয়, সে-অপরাধের শাস্তি খোদ সে-অপরাধ হতে পারে না। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হচ্ছে, মানুষের জাজমেন্টে ভুল হতে পারে, এবং কোনো জাজমেন্টে কারও প্রাণ সংহার করে সে-জাজমেন্ট ভুল প্রমাণিত হলে, তার সংশোধনের কোনো উপায় থাকে না।
আমি শেখ হাসিনার মৃত্যদণ্ডের বিরোধিতা করি মানে এই নয় যে, আমি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচারেরও বিরোধিতা করি। আমি যে-কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে—বিশেষত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে—আনীত অভিযোগের বিচারের পক্ষে, যদি তা প্রতিশোধমূলক না হয়ে ন্যায়বিচার হয়।
যুগে-যুগে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের নীতিবাক্য হচ্ছে, “আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, আমাদের কোনো হাত নেই।” এ-নীতিকথা শেখ হাসিনাও বলেছেন জামায়াতের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের ও খালেদা জিয়ার আর্থিক অনিয়মের বিচারে। কিন্তু বিষয়টি কি আসলে তাই?
মানুষ কি বিশ্বাস করে যে, আইন ও বিচার তার নিজের গতিতে চলে? নাকি ক্ষমতার দিকে ঝুঁকে থাকে আইনের দাঁড়িপাল্লা? আমার মনে হয়, আইন চলে ক্ষমতাসীনের নির্দেশিত পথে, এবং তা শুধু বাংলাদেশেই নয়, কম-বেশি বিশ্বের সকল দেশেই।
যাহোক, আমার মনে হয়, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড সম্ভবত তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে না হয়ে বরং তাকে বশে আনার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকবে। ইংরেজিতে যাকে আমরা বার্গেইনিং চিপ (bargaining chip) বলি।
কারা কার সাথে কী অর্জন করতে বার্গেইন করতে চাইছে, তা এক ভিন্ন আলোচনা, যা স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার দাবি রাখে। তবে, এখানে ভারতের বিবৃতিটি প্রণিধানযোগ্য। শেখ হাসিনার আশ্রয়ক-দেশ ভারত তার সতর্ক ও ইঙ্গিতপূর্ণ এক বিবৃতিতে বলেছে: ‘India has noted the verdict announced by the “International Crimes Tribunal of Bangladesh” concerning former Prime Minister Sheikh Hasina. As a close neighbour, India remains committed to the best interests of the people of Bangladesh, including in peace, democracy, inclusion and stability in that country. We will always engage constructively with all stakeholders to that end,’ অর্থাৎ, ‘[বাংলাদেশের] প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়ে “বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল” কর্তৃক ঘোষিত রায় ভারত লক্ষ করেছে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতা-সহ দেশটির জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি বদ্ধপরিকর রয়েছে। আমরা সেই লক্ষ্যে সর্বদাই সকল সংশ্লিষ্ট-পক্ষের সাথে গঠনমূলকভাবে নিয়োজিত হবো।’
ভারতের বিবৃতির অভিধার্থের বাইরে যে নিহিতার্থ আমার ডিসকোর্স অ্যানালাইসিসে বোধিত হয়েছে, তা থেকে নীচের চারটি বিষয় তুলে ধরেছি।
(১) ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রতি নিপুণ নজর রাখছে, এবং শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডর রায় ঘোষণা তাদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়া ভাঙ্গার থ্রেশল্ট স্পর্শ করেছে।
(২) শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডর রায় ঘোষণাকারী ট্রাইব্যুনালের নামটি (“International Crimes Tribunal of Bangladesh”) উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে বন্দি করে ভারত কার্যত প্রতিষ্ঠানটির বৈধতা কিংবা নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
(৩) ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে উদাসীন নয়, বরং দায়বোধে সচেতন রয়েছে, দেশটিতে শান্তি [গৃহযুদ্ধের হুঁশিয়ারি] স্থিতিশীলতা [পাকিস্তান যাতে অস্থিতিশীল না করে], গণতন্ত্র [নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া চাই], অন্তর্ভুক্তি [আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নয়], ও জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের [ভারতের মতে ] প্রতি।
(৪) বাংলাদশের সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে ভারত গঠনমূলকভাবে নিযুক্ত হয়ে একটি সমঝোতায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী।
আমার বিচারে, ইউনূস সরকারের নানা সময়ের উসকানিমূলক মন্তব্যের বিপরীতে ভারত রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পর্যায়ে কোনো প্রকারের অপরিপক্ক কূটনৈতিক আচরণ করেনি, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশটিকে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক প্রকারের বোঝাপড়ার সূত্রে ভারত এখন বাংলাদেশ বিষয়ে তার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূমিকা পালনের কথা বিশ্ববাসীকে ১৯৭১ সালের মতোই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট
লন্ডন, ইংল্যান্ড
