৩৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ‘যৌথ ঘোষণা’
অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ-নিয়ন্ত্রণে ৬ পদক্ষেপ ও ৫ প্রতিশ্রুতি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:০৪, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০৩:২৩, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দেশে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও রাসায়নিক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে সরকার। পাশাপাশি শিশুদের জন্য অস্বাস্থ্যকর খাদ্য-পানীয়ের বিপণন সীমিত, আমদানি ও রপ্তানি খাদ্যে পুষ্টি মানদণ্ড কার্যকর এবং উচ্চ চিনি, লবণ ও ট্রান্স-ফ্যাটযুক্ত পণ্য সীমিত করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে।
এ জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করা হয়েছে। এখন থেকে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ কাজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করবে।
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যৌথ ঘোষণা বাস্তবায়ন কর্মকৌশল নির্ধারণ সম্পর্কিত সভায় এসব বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খাদ্য উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫টি মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ মো. আব্দুর রশীদ ও সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই যৌথ ঘোষণার বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়।
এর আগে গত ২০ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ (যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, আঘাতজনিত অসুস্থতা ইত্যাদি) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বৃদ্ধিতে ৩৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ এই যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে।
যেভাবে বাস্তবায়ন হবে যৌথ ঘোষণা
সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ মো. আব্দুর রশীদ বলেন, জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং আগামী প্রজন্মকে যথাযথভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং সমন্বিতভাবে তা সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে করতে হবে। সে জন্যই ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করা হয়েছে ৷
সচিব আরও বলেন, এখন প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দিক-নির্দেশনামূলক সার্বিক সহযোগিতা করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো কারিগরি সমর্থন নিশ্চিত করবে।
ঘোষণায় যা অগ্রাধিকার পেল
যে সব বিষয়াদি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে আলোচনা করা হয় সেগুলো হলো:
১. মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে স্বাক্ষরকারী সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের তদারকি কমিটির মাধ্যমে যৌথ ঘোষণা বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে।
২. কৃষি মন্ত্রণালয়ের তক্তাবধানে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী ফলমূল-শাকসবজির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ, তামাক থেকে বিকল্প ফসল চাষে প্রণোদনা প্রদান, কৃষক সহায়তা, বাজার ও মূল্য স্থিতিশীলতা এবং কোল্ড স্টোরেজ ও পরিবহনসহ ফসল সংরক্ষণের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে।
৩. খাদ্য নিরাপত্তা ও ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে সামনের ও পিছনের অংশে লেবেলিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিশুদের জন্য অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও পানীয়ের বিপণন সীমিত এবং ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
৪. মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নিরাপদ ও পুষ্টিকর মাছ, দুধ, ডিম ও চর্বিহীন মাংস উৎপাদন ও বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নীত করা হবে। অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও রাসায়নিক ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তদারকি, পরিদর্শন ও প্রয়োগ কার্যক্রম জোরদার করা হবে। এ ছাড়া স্বল্প-লবণ সংরক্ষণ পদ্ধতি ও রপ্তানির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গবেষণা, উদ্ভাবন ও নীতি সহায়তা দেওয়া হবে।
৫. শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে খাদ্য লেবেলিং ও ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের সামনের ও পেছনের অংশে পুষ্টি উপাদান, অ্যালার্জেন, সোডিয়াম, চিনি ও ক্ষতিকর চর্বির তথ্য স্পষ্টভাবে প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিল্পখাত পুনর্গঠন ও প্রণোদনার মাধ্যমে লবণ, চিনি, ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট হ্রাসে খাদ্য পণ্যের পুনর্গঠন উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
৬. বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আমদানি ও রপ্তানি খাদ্যে পুষ্টি মানদণ্ড কার্যকর, উচ্চ চিনি, লবণ ও ট্রান্স-ফ্যাটযুক্ত পণ্য সীমিতকরণ, নতুন ধরনের তামাক ও নিকোটিন পণ্য নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য ও তামাকজাত পণ্যের ক্ষেত্রে পোর্টে স্ক্রিনিং কার্যক্রম চালু করা হবে।
বাস্তবায়নে ৫ দফা প্রতিশ্রুতি
‘যৌথ ঘোষণা'য় পাঁচ দফা প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলা হয়, ঘোষণা স্বাক্ষরকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঘোষণা বাস্তবায়নে পাঁচ ধরণের উদ্যোগ নেবে। প্রতিশ্রুতিগুলো হলো—
১. নীতি প্রণয়নে অগ্রাধিকার: সব নীতিতে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কর্মকৌশল ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং নির্ধারণে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার এবং প্রয়োজনবোধে বিদ্যমান নীতিসমূহে সংশোধন করা।
২. কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন: জাতীয় অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত সাশ্রয়ী কার্যপন্থা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ মানব ও আর্থিক সম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং অধস্তন দপ্তর/সংস্থার মাধ্যমে মাঠপর্যায়সহ সকল স্তরে পরিকল্পিত কার্যক্রম তদারকি, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা।
৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সর্বজনীন অংশগ্রহণ: অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি ও প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম সর্বাত্মক সরকারি এবং সর্বাত্মক সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা যেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সক্রিয় ও অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
৪. সমন্বয় ও সহযোগিতা: প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ জাতীয় অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা সমন্বিত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং সমন্বয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করা।
৫.অগ্রগতি পর্যালোচনা: প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ যৌথ ঘোষণার অগ্রগতি নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করা এবং উল্লেখযোগ্য সফলতা সংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা; শনাক্তকৃত চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।