শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

| ১১ আশ্বিন ১৪৩২

মৈত্রেয়ী দেবী: সাহিত্যভুবনের অনন্য আলো

সমাজকাল ডেস্ক 

প্রকাশ: ১৩:০১, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মৈত্রেয়ী দেবী: সাহিত্যভুবনের অনন্য আলো


আজ ১ সেপ্টেম্বর, বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য বিশেষ এক দিন। এদিন জন্মেছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক ও সমাজকর্মী মৈত্রেয়ী দেবী (১৯১৪–১৯৯০)। তার সাহিত্যকর্ম যেমন বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন অসাধারণ মানবিক সত্তা হিসেবে। ‘ন হন্যতে’ উপন্যাসের লেখিকা হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত, কিন্তু তাঁর জীবনপথে ছড়িয়ে আছে বহুমাত্রিক অবদান, যা আজও পাঠক ও সমাজকে অনুপ্রাণিত করে।

শৈশব ও শিক্ষা
মৈত্রেয়ী দেবীর জন্ম চট্টগ্রামে, বাবার কর্মস্থলে। তার পিতা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন খ্যাতনামা দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক এবং মা সুরমা দেবী ছিলেন ভারতের প্রথম নারী ডক্টরেট। ছোটবেলা কেটেছে বরিশালের গৈলা গ্রামে, যেখানে গ্রামীণ প্রকৃতি ও পারিবারিক সাহিত্যিক পরিবেশ তার চিন্তা-ভাবনার ভিত্তি গড়ে দেয়। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

সাহিত্যজীবনের সূচনা
মাত্র ষোল বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “উদিত” (১৯৩০), যার ভূমিকাটি লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় চিত্তছায়া, হিরন্ময় পাখি, বিধি ও বিধাতা প্রভৃতি। তবে তাঁর খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “ন হন্যতে” (It Does Not Die: A Romance)। বইটিতে তিনি তুলে ধরেন তাঁর জীবনের এক অম্লমধুর অধ্যায়, যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত হয় ঔপনিবেশিক ভারতের সামাজিক বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক সংকট।

রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে
মৈত্রেয়ী দেবীর জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল গভীর। মংপুতে অবস্থানকালে তিনি কবিগুরুর সাথে এক বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সেই স্মৃতি তিনি লিপিবদ্ধ করেন “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ” গ্রন্থে, যা পরবর্তীতে Tagore by Fireside নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাঁর লেখা অন্যান্য বই যেমন “স্বর্গের কাছাকাছি”, “কবি সার্বভৌম”, “রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে”—সাহিত্যসমালোচনার অঙ্গনে বিশেষ স্থান অধিকার করে।

সমাজসেবামূলক অবদান

সাহিত্য ছাড়াও মৈত্রেয়ী দেবী সক্রিয় ছিলেন সমাজকর্মে। তিনি “কাউন্সিল ফর প্রমোশন অব কমিউনাল হারমনি” প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৬৪ সালে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ়ভাবে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন এবং কলকাতার কাছে “খেলাঘর” নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন অনাথ শিশুদের জন্য। সেখানে কৃষি, পশুপালন ও শিশু লালনপালনের মাধ্যমে সমাজসেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৭৬) – ন হন্যতে গ্রন্থের জন্য।
পদ্মশ্রী (১৯৭৭) – ভারত সরকারের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (২০১২) – মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য।
এছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়ন রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁকে বিশেষ পদক প্রদান করে।

উত্তরাধিকার
মৈত্রেয়ী দেবীর সাহিত্য শুধু আত্মজীবনীমূলক নয়, বরং গভীর মানবিক বোধ ও সমাজমননের প্রতিফলন। তাঁর কলমে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত প্রেম-বিরহের বেদনাময় কাহিনি উঠে এসেছে, অন্যদিকে তেমনি ধরা দিয়েছে দার্শনিক ভাবনা ও সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, উপন্যাসিক, চিন্তাবিদ এবং মানবিক সেবার নিরলস কর্মী।

আজ মৈত্রেয়ী দেবীর জন্মদিনে তাকে স্মরণ করা মানে শুধু একজন সাহিত্যিককে নয়, বরং এক মানবিক আলোকবর্তিকাকে শ্রদ্ধা জানানো। তার সৃষ্টি, তার সমাজসেবা এবং তার জীবনের সাহসী পদক্ষেপ বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে অনন্য এক অধ্যায় হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন