সক্রেটিসের দর্শনে জীবনের চিরন্তন পাঠ
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮:৫০, ১৮ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৫২, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিকদের একজন সক্রেটিস। দুই হাজার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার বাণী আজও প্রাসঙ্গিক। প্রাচীন গ্রীসের এই দার্শনিক মানুষকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ভাবতে হয়, কীভাবে নিজেকে জানতে হয় এবং কীভাবে জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হয়। তার দর্শন শুধু তর্ক বা জ্ঞানচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং নৈতিকতা, আত্মসচেতনতা ও সচেতন জীবনের বাস্তব দিকনির্দেশনা হয়ে উঠেছিল।
সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য নয়।’ এই একটি বাক্যেই তার সমগ্র দর্শনের সারাংশ নিহিত। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছেন তিনি। শিখিয়েছেন প্রশ্ন করতে, বিশ্লেষণ করতে এবং সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে। আজকের যান্ত্রিক ও ব্যস্ত জীবনে সক্রেটিসের সেই শিক্ষা যেন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তার আটটি অমর বাণী এখনো আমাদের শেখায় কীভাবে বাঁচতে হয়, কীভাবে মানুষ হতে হয়। তা উল্লেখ করা হলো।
এক. অপরীক্ষিত জীবন অর্থহীন : সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, আত্মসমালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসাই সচেতন জীবনের মূল। আমরা যদি নিজের চিন্তা, আচরণ ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন না করি, তবে আমাদের জীবন নিছক যান্ত্রিকতায় পরিণত হয়। নিয়মিত আত্মপর্যালোচনাই মানুষকে পরিণত করে প্রজ্ঞাবান ও সচেতন সত্তায়।
দুই. নিজেকে জানা : নিজেকে জানা মানে নিজের দুর্বলতা, আকাঙ্ক্ষা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানা। আত্মপরিচয় মানুষকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করে। যে নিজেকে জানে, সে জানে তার জীবনের লক্ষ্য কী এবং সে কীভাবে সেই পথে চলবে।
তিন. যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা : সক্রেটিস শিখিয়েছেন, সুখ আসে না অধিক অর্জনে, বরং সুখ আসে কৃতজ্ঞতায়। আমরা যত বেশি কৃতজ্ঞ হবো, তত বেশি সুখী হতে পারব। যে মানুষ বর্তমানে সন্তুষ্ট, সে ভবিষ্যতের লোভে অন্ধ হয় না। এই মনোভাব আমাদের জীবনে এনে দেয় প্রশান্তি ও স্থিরতা।
চার. বন্ধুত্বে ধীর হওয়া, স্থির থাকা : সক্রেটিস বন্ধুত্বকে দেখেছেন নৈতিক সম্পর্ক হিসেবে। তিনি বলেছিলেন, বন্ধুত্বে প্রবেশ করতে হবে সচেতনভাবে, কিন্তু একবার সত্যিকারের বন্ধুত্ব হলে তাতে থাকতে হবে অটল। সচেতন মানে এমন সম্পর্ক তৈরি করা, যা পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও আত্মিক উন্নতির উপর দাঁড়িয়ে হয়ে থাকে।
পাঁচ. শেখানো নয়, চিন্তা করানোই শিক্ষার মূল : সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান কাউকে দেওয়া যায় না, তাকে চিন্তা করতে শেখানো যায়। তার ‘সক্রেটিক পদ্ধতি’ ছিল প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনের দ্বার খুলে দেওয়া। চিন্তার স্বাধীনতাই জ্ঞানের জন্ম দেয়, এই সত্য তিনি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন।
ছয়. প্রজ্ঞার শুরু বিস্ময়ে : বিস্মিত হওয়া মানেই প্রশ্ন করা, অনুসন্ধান শুরু করা। সক্রেটিস বলেছিলেন, যে মানুষ আশ্চর্য হতে জানে, সে জ্ঞান লাভের প্রথম ধাপে পৌঁছে যায়। বিস্ময় আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে কৌতূহল, আর কৌতূহলই প্রজ্ঞার জন্ম দেয়।
সাত. নিজেকে খুঁজে পেতে নিজের মতো ভাবা : অন্যের চিন্তা অনুকরণ নয়, বরং নিজের চিন্তা সৃষ্টি করাই আত্ম-আবিষ্কারের পথ। সক্রেটিস মানুষকে শিখিয়েছেন স্বাধীনভাবে ভাবতে, সমাজের প্রচলিত ধারণা নয়, বরং যুক্তি ও বিবেকের ভিত্তিতে সত্য খুঁজতে। সচেতন জীবন মানে নিজের মস্তিষ্ক ও বিবেককে সক্রিয় রাখা।
আট. সন্তুষ্টিই প্রকৃত সম্পদ : সক্রেটিস মনে করতেন, বিলাসিতা মানুষকে গরিব করে, আর সন্তুষ্টি সমৃদ্ধ করে। যে মানুষ সহজ জীবন বেছে নেয়, সে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত থাকে। সত্যিকারের সুখ আসে আত্মনির্ভরতা, সরলতা ও নৈতিক জীবনের মাধ্যমে।
সক্রেটিসের এই আটটি শিক্ষা আজও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আধুনিক জীবনের অস্থিরতা, প্রতিযোগিতা ও বিভ্রান্তির ভেতরে তার বাণী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের মূল উদ্দেশ্য ভোগ নয়, বোধ। তার দর্শন শেখায় আত্মচিন্তা, কৃতজ্ঞতা, নৈতিকতা ও স্বাধীন চিন্তার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে সচেতন, শান্ত ও অর্থপূর্ণ জীবন।
সক্রেটিসের চিন্তা যেন আজকের মানুষকেও জাগিয়ে তোলে। আমাদের মনে প্রশ্ন তোলে, আমরা কি সত্যিই নিজেদের জানি? আমরা কি সত্যিই ভাবতে শিখেছি? সক্রেটিসের শিক্ষা সেই ভাবনার দ্বার খুলে দেয়, যেখানে শুরু হয় এক নতুন, গভীর ও সচেতন জীবনের যাত্রা।