শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

| ৩ কার্তিক ১৪৩২

প্রশান্ত মহাসাগরে তাপমাত্রার রেকর্ড বৃদ্ধি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬:০৮, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

প্রশান্ত মহাসাগরে তাপমাত্রার রেকর্ড বৃদ্ধি

প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরাংশে এই বছর রেকর্ড পরিমাণ উষ্ণতা দেখা দিয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২০২২ সালের আগের সর্বোচ্চ রেকর্ডের চেয়ে ০.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি— যা প্রায় ভূমধ্যসাগরের দশগুণ এলাকার সমান পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিবিসির জলবায়ু বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এটি এমন এক ‘মেরিন হিটওয়েভ’ বা সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ যা বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা দিতে হিমশিম খাইয়ে দিচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা যে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ বাড়ায়, তা বহু গবেষণায় প্রমাণিত। কিন্তু এত বিশাল অঞ্চলে একযোগে এমন উষ্ণতার কারণ ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বার্কলি আর্থ-এর বিজ্ঞানী জিক হাউসফাদার বলেন,“উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে যা ঘটছে, তা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক। এত বড় এলাকায় এমন দ্রুত তাপমাত্রা বৃদ্ধি সত্যিই বিস্ময়কর।”
ইউরোপীয় আবহাওয়া সংস্থা কোপারনিকাস-এর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে,
১৯৪০ সাল থেকে এ পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তাপমাত্রার যে রেকর্ড রাখা হয়েছে,২০২৫ সালের তাপমাত্রা তার সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।
সমুদ্রের উষ্ণতা বেড়েছে এত দ্রুত যে, বার্কলি আর্থ-এর হিসাব অনুযায়ী, এমন তাপমাত্রা ঘটার সম্ভাবনা বছরে এক শতাংশেরও কম।

এই উষ্ণতার পেছনে আংশিকভাবে প্রাকৃতিক আবহাওয়ার তারতম্য দায়ী হতে পারে-যেমন দুর্বল বাতাসের কারণে গ্রীষ্মের তাপ উপরের স্তরেই আটকে থাকা। তবুও এটি পুরো চিত্র ব্যাখ্যা করতে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন গবেষকেরা।
একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো জাহাজে ব্যবহৃত জ্বালানির পরিবর্তন।

২০২০ সালের পর থেকে নৌপরিবহনে ব্যবহৃত তেল থেকে সালফার ডাইঅক্সাইড নির্গমন ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে, যা আগে সূর্যালোক প্রতিফলিত করে পরিবেশকে কিছুটা ঠান্ডা রাখত।

এই কৃত্রিম শীতলতা কমে যাওয়ায় এখন সূর্যের তাপ পুরোপুরি শোষিত হচ্ছে। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের পানি আরও গরম হচ্ছে।
একইভাবে, চীনের শহরাঞ্চলে দূষণ কমানোর প্রচেষ্টাও এই অঞ্চলের সূর্যালোক-প্রতিফলন প্রক্রিয়া দুর্বল করে দিয়েছে বলে ধারণা।

এই সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ ইতিমধ্যে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ভয়াবহ গ্রীষ্মকালীন তাপদাহ
এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবল ঝড়-বৃষ্টির কারণ হয়ে উঠেছে।
লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ুবিদ অধ্যাপক অ্যামান্ডা মেইকক বলেন,“প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ পানি বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত আর্দ্রতা যোগ করে ঝড় ও বৃষ্টিকে সুপারচার্জ করছে।”
এই উষ্ণ সমুদ্র থেকে উৎপন্ন ‘অ্যাটমস্ফেরিক রিভার’ বা বায়ু-নদীগুলো অতিরিক্ত আর্দ্রতা বহন করে স্থলে নিয়ে আসে। যা বৃষ্টি কিংবা শীতে ভারী তুষারপাত ঘটাতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরের এই তাপপ্রবাহ টেলিকানেকশন-এর মাধ্যমে ইউরোপ পর্যন্ত প্রভাব ফেলতে পারে।এর ফলে বায়ুমণ্ডলে তৈরি হওয়া তরঙ্গধারা উত্তর আটলান্টিক ও ইউরোপীয় অঞ্চলে উচ্চচাপের বলয় সৃষ্টি করতে পারে,যা আর্কটিক অঞ্চলের ঠান্ডা বায়ু টেনে এনে ইউরোপে শীতের শুরুটা আরও ঠান্ডা করে তুলতে পারে।
শীতের শেষভাগে উষ্ণ প্রশান্ত মহাসাগর বরং কিছু এলাকায় মৃদু ও বৃষ্টিপ্রবণ আবহাওয়া আনতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে লা নিনা-র প্রাথমিক লক্ষণ। যেখানে সমুদ্র পৃষ্ঠের পানি অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা।মার্কিন নোয়া জানাচ্ছে, দুর্বল লা নিনা পরিস্থিতি আগামী কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে।

লা নিনা সাধারণত ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে শীতের শুরুতে ঠান্ডা, কিন্তু শেষভাগে উষ্ণ আবহাওয়া বয়ে আনে।
এই বছর যেহেতু লা নিনা দুর্বল, তাই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের অস্বাভাবিক তাপই চলতি শীতের আবহাওয়ার ধরন নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।

প্রশান্ত মহাসাগরের এই “ওয়ার্ম ব্লব” এখন জলবায়ু গবেষণার বড় ধাঁধা।

প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানবসৃষ্ট প্রভাব মিশে তৈরি করছে এক রহস্যজনক উষ্ণ পৃথিবী—যার পরিণতি হয়তো ইউরোপের ঠান্ডা শীত কিংবাএশিয়ার গ্রীষ্মকালীন দুর্যোগের মধ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন