তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন না হলে খাদ্য সংকট বাড়বে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬:৩৭, ৫ নভেম্বর ২০২৫
ছবি: বিএনটিটিপি
দেশে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমিতেও বেড়েছে তামাক চাষ। খাদ্য ফলানোর জমি তামাক চাষে ব্যবহৃত হওয়ায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা গেলে তামাক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কৃষকদেরও খাদ্যশস্যে ফিরে আসতে উৎসাহিত করা সম্ভব।
বুধবার (৫ নভেম্বর) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো (বিইআর) সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘কোম্পানির আগ্রাসনে বাড়ছে তামাক চাষ, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। কর্মশালাটি যৌথভাবে আয়োজন করে বিইআর, বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) এবং বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)।
কর্মশালার সেশন পরিচালনা করেন একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি ও তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষক সুশান্ত সিনহা, যিনি বিএনটিটিপির টেকনিক্যাল কমিটিরও সদস্য।
সুশান্ত সিনহা বলেন, তামাক পাতা রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার তামাক চাষ বৃদ্ধির প্রধান অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে রপ্তানির পাশাপাশি দেশে তামাক উৎপাদনও বেড়েছে, যা কৃষকের ক্ষতি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ।
তিনি আরও বলেন, ‘তামাক কোম্পানিগুলো ‘তামাক চাষ লাভজনক’— এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে কৃষকদের ভুল পথে নিচ্ছে। অথচ বাস্তবে তামাক চাষের অঞ্চলগুলোই দেশের দারিদ্র্যের শীর্ষে।’
সুশান্ত সিনহা অভিযোগ করেন, কর বৃদ্ধি ও আইন সংশোধনের উদ্যোগ ঠেকাতে তামাক কোম্পানিগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করছে। চোরাচালানের গল্প ছড়িয়ে এবং রাজস্ব কম দেখিয়ে তারা জনস্বার্থবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। তার দাবি, ‘সরকারের উচিত কোম্পানির ফাঁদে না পড়ে জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে দ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও একটি সমন্বিত তামাক করনীতি প্রণয়ন করা।’
বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন বলেন, তামাক কোম্পানি কমপক্ষে ১০টি খাতে ক্ষতি করছে, অথচ তাদের করফাঁকির সঠিক হিসাব নেই। তিনি বলেন, ‘তামাক চাষে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতির পাশাপাশি রাজস্ব ফাঁকিও বাড়ছে। সবমিলিয়ে বছরে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।’
তিনি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তামাক পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটিতে তামাক কোম্পানির আধিপত্যেরও সমালোচনা করে বলেন, ‘যারা কিনবে, তারাই যদি দাম নির্ধারণ করে, তাহলে কৃষক বঞ্চিতই থাকবে।’
বিএনটিটিপির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্য নীতি বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, ‘হাইকোর্টের আপিল বিভাগ স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে— দেশে নতুন করে কোনো তামাক কোম্পানি স্থাপন বা তামাক চাষ বাড়ানো যাবে না। অথচ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, তামাক চাষ আরও বেড়েছে এবং নতুন করে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা আদালতের আদেশের পরিপন্থী।’
তিনি বলেন, ‘সরকার খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়াতে তৎপর, কিন্তু তামাকের মূল্য ও কর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নানা অজুহাত দেখায়— এটি জনস্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীনতার পরিচায়ক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিএনটিটিপির টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক ড. রুমানা হক সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের এখনই তামাক চাষ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন অপরিহার্য। একই সঙ্গে কৃষকদের বিকল্প ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তামাক থেকে যে রাজস্ব আসে, তার দ্বিগুণেরও বেশি ব্যয় হয় তামাকজনিত রোগে চিকিৎসা খাতে। তাই জনস্বার্থে তামাক পাতা ও তামাকজাত দ্রব্য রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহাল করা জরুরি।’
উল্লেখ্য, বিভিন্ন গণমাধ্যমের ৩৫ জন কৃষি সাংবাদিক এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন।
