শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

| ১১ আশ্বিন ১৪৩২

গ্রিসের ফোন-স্পাইওয়্যার কেলেঙ্কারি কোর্টে

গ্রিসের ‘ওয়াটারগেট’ কাণ্ড

সমাজকাল ডেস্ক 

প্রকাশ: ১৬:০৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৬:০৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

গ্রিসের ‘ওয়াটারগেট’ কাণ্ড

প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিস। ফাইল ছবিটি সংগৃহিত

গ্রিসের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি এখন আদালতের কাঠগড়ায়। ‘Predator’ নামের স্পাইওয়্যার সফটওয়্যারের মাধ্যমে দেশটির উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী, বিচারক, সামরিক কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন টার্গেট করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। সমালোচকরা একে বলছেন গ্রিসের “ওয়াটারগেট মুহূর্ত”।
২০২২ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আইটি বিশেষজ্ঞরা পাসোক নেতা নিকোস আন্দ্রুলাকিসের ফোনে সন্দেহজনক টেক্সট মেসেজ শনাক্ত করেন, যা ‘Predator’ সফটওয়্যার বহন করছিল। একইসঙ্গে জানা যায়, গ্রীসের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইওয়াইপি “জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে” আন্দ্রুলাকিসকে নজরদারিতে রেখেছিল। এখান থেকেই পুরো কেলেঙ্কারির সূত্রপাত।
তদন্তের সূত্রে বেরিয়ে আসে, কমপক্ষে ৮৭ জনকে ‘প্রিডেটর’-এর টার্গেট করা হয়েছিল এবং এর মধ্যে ২৭ জনকে একই সময়ে ইওয়াইপি পর্যবেক্ষণ করেছে। এতে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সেনাপ্রধান এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারাও ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিস ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেই ইওয়াইপি-কে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীনে নিয়ে আসেন। কেলেঙ্কারি ফাঁস হতে ইওয়াইপি প্রধান প্যানাগিওতিস কন্টোলিয়ন ও প্রধানমন্ত্রী মিৎসোটাকিসের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তথা ভাতিজা গ্রিগরিস দিমিত্রিয়াদিস পদত্যাগ করেন।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। আদালতে দাঁড় করানো হয়েছে দু’জন গ্রিক ও দু’জন ইসরায়েলি নাগরিককে—যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মূলত স্পাইওয়্যার বিপণনসংক্রান্ত। সরকারপক্ষ বলছে, কোনো সরকারি সংস্থা ‘প্রিডেটর’ ব্যবহার করেনি। তবে হেলেনিক ডেটা প্রোটেকশন অথরিটি এবং স্বাধীন সাংবাদিকরা বলছেন—ইওয়াইপি ও প্রিডেটর  ও লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে মিল থাকায় বিষয়টি নিছক কাকতালীয় হতে পারে না।
অভিযোগ উঠেছে—মামলাটি ইচ্ছাকৃতভাবে নিচু স্তরের বিচারকের হাতে দেওয়া হয়েছে, যেন মূল রাজনৈতিক চেইন বা উচ্চপর্যায়ের দায় উন্মোচিত না হয়। সমালোচকরা এটিকে বলছেন “ছোটদের সাজা, বড়দের বাঁচানো” কৌশল।
কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর গ্রিস সরকার যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষায় নতুন আইন পাস করে। এতে কিছু নিরাপত্তা সুরক্ষা যোগ হলেও নাগরিকরা আর জানতে পারবেন না তারা অতীতে নজরদারির আওতাভুক্ত ছিলেন কি না। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এভাবে জনগণের অধিকার সীমিত করা হয়েছে।
ইনটেলেক্সা নামের ইসরায়েলি-গ্রিক যৌথ কোম্পানির অফিসে অভিযান চালানো হলেও, তেমন প্রমাণ উদ্ধার হয়নি। সমালোচকদের অভিযোগ—সরকার “খুঁজে না পাওয়ার অভিনয়” করছে।

যেহেতু নিকোস আন্দ্রুলাকিস তখন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন, তাই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি (PEGA) গঠন করে। এর প্রতিবেদক সোফি ইন ‘ট ফেল্ড স্পষ্ট ভাষায় বলেন—গ্রিস সরকার বারবার তদন্তে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আডিএইচএ (Hellenic Authority for Communication Security and Privacy)-এর সাবেক প্রধান ক্রিস্টোস রামোস বলেছেন, “গ্রিসের রাজনৈতিক সংস্কৃতি স্বাধীন কর্তৃপক্ষকে সহ্য করতে পারে না। ওয়্যারট্যাপিং কেলেঙ্কারি আমাদের গণতন্ত্রের জন্য এক আঘাত।”
সাংবাদিক থানাসিস কুকাকিস, যিনি নিজেও Predator ও EYP-এর নজরদারিতে ছিলেন, বলেন—“যা রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি হিসেবে শুরু হয়েছিল, এখন তা প্রাতিষ্ঠানিক কেলেঙ্কারিতে রূপ নিয়েছে।”
জার্নালিস্ট এলিজা ট্রিন্টাফিল্লৌ মনে করেন—“কেউ যদি বিস্তারিত না জানে, তাহলে ভাববে চারজন ব্যক্তি নিজেরাই ৮৭ জনকে টার্গেট করেছেন। অথচ এ ধরনের সফটওয়্যার সারা বিশ্বে কেবল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্যই তৈরি।”
গ্রিস সরকারের দাবি—তাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই যা সরাসরি রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে। কিন্তু সমালোচক, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন—মূল শক্তিশালী নেটওয়ার্ককে আড়াল করে মামলাকে সীমিত পর্যায়ে রাখা হচ্ছে।
এ ঘটনায় গ্রিসে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ইউরোপের নজরদারির আলোচনায় এটি এখন এক গুরুত্বপূর্ণ নজির—যেখানে প্রশ্ন ঘুরেফিরে এক জায়গাতেই আসে: সরকার কি সত্যিই দায়মুক্ত, নাকি দায় আড়াল করতে সফল হয়েছে?

আরও পড়ুন