শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

| ১১ আশ্বিন ১৪৩২

সমাজ পরিবর্তনে তরুণদের আরএডি ফাউন্ডেশন

হাসান আল মামুন

প্রকাশ: ০০:২২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সমাজ পরিবর্তনে তরুণদের আরএডি ফাউন্ডেশন

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার কয়েকজন তরুণ সমাজকর্মী মিলে প্রতিষ্ঠা করেন আরএডি ফাউন্ডেশন। শুরু থেকেই তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে সচেতন করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। ‘আর্তমানবতার সেবায় আমরা’, এই স্লোগানকে সামনে রেখে তারা মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেন। 

প্রথমদিকে কাজের মূল ক্ষেত্র ছিল রেললাইন ও তার আশপাশের এলাকা। কারণ দেশে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে অনেক। এতে শুধু ট্রেনের জানালা ভাঙা বা যাত্রী আহত হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, অনেক সময় বড় দুর্ঘটনাও ঘটে। আরএডি ফাউন্ডেশনের তরুণরা মাইকিং এবং লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে শুরু করেন, পাথর নিক্ষেপ কতটা ক্ষতিকর এবং এজন্য আইন কী শাস্তি নির্ধারণ করেছে। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় ভূমিকা রাখতে থাকেন।

এরপর ২০২২ সাল থেকে তারা নজর দেন শিশুদের দিকে। বারবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে, অসচেতনতার কারণে শিশুরা মারা যাচ্ছে, ওরস্যালাইনের সঠিক মিশ্রণ না জানার ফলে ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা। সেই প্রেক্ষাপটে আরএডি ফাউন্ডেশন দেশের বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন শুরু করে। তারা শিশুদের হাতে-কলমে শিখিয়ে দেয় ওরস্যালাইন তৈরি ও ব্যবহার করার নিয়ম। শিক্ষার্থীদের মধ্য দিয়ে এই জ্ঞান পরিবার ও সমাজে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এক অর্থে, তারা এক অদৃশ্য মৃত্যুফাঁদ থেকে শিশুদের বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

শুধু রেললাইন বা স্কুলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি সংগঠনটির কার্যক্রম। তারা ধীরে ধীরে নানা মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেমন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ঈদবস্ত্র ও শীতবস্ত্র বিতরণ, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ উপহার দেওয়া, মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তদাতা ব্যবস্থা করা, ফুটপাতে বসবাসকারী মানুষদের একবেলার খাবার বিতরণ করা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। প্রতিটি কাজের পেছনে একটাই লক্ষ্য, মানুষকে সহায়তা করা এবং তাদের জীবনে সামান্য হলেও স্বস্তি এনে দেওয়া।

চট্টগ্রামে সূচনা হলেও আরএডি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম এখন দেশের আরও কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত হয়েছে। ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরা ও বান্দরবানে তাদের শাখা চালু হয়েছে। এর ফলে ভৌগোলিকভাবে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তাদের কার্যক্রমের আওতায় আসছে। স্থানীয় তরুণদের সম্পৃক্ত করে প্রতিটি শাখা নিজ নিজ এলাকায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও মানবিক সেবা পরিচালনা করছে।

প্রতিষ্ঠাতা মানিকুর রহমানের ভাষায়, ‘দেশের মানুষকে সচেতন করে আসছি আমরা। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে চাই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলোর অধিকাংশই নিরক্ষর, তাদের জন্য চলবে আমাদের বিশেষ সচেতনতা ক্যাম্পেইন।’ তার এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, আরএডি ফাউন্ডেশন কেবল শহরের শিক্ষিত বা সুবিধাভোগীদের জন্য নয়, বরং সমাজের প্রান্তিক ও অবহেলিত মানুষের জন্য কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আজকের পৃথিবীতে অসংখ্য সংগঠন আছে, যারা বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু মাঠপর্যায়ে তাদের কার্যক্রম সীমিত। আরএডি ফাউন্ডেশন সেই জায়গায় ভিন্ন। তারা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কখনো লিফলেট হাতে রেললাইন ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনো স্কুলে গিয়ে শিশুদের হাতে-কলমে শিখিয়ে দিচ্ছে ওরস্যালাইন বানানোর নিয়ম, কখনো আবার শীতার্ত ও বস্ত্রহীনদের গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছে নতুন কাপড়।

সমাজের পরিবর্তন হঠাৎ ঘটে না, এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, আন্তরিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা। আরএডি ফাউন্ডেশনের কাজগুলো হয়তো বড় কোনো প্রকল্পের মতো মনে নাও হতে পারে, কিন্তু এই ছোট ছোট উদ্যোগই একদিন সমাজে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ প্রতিটি সচেতন মানুষ, প্রতিটি রক্ষা পাওয়া শিশু এবং প্রতিটি হাসি, সেই পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে।

এভাবেই একদল তরুণের হাতে গড়ে উঠা সংগঠন ধীরে ধীরে মানুষের আস্থা অর্জন করছে। তাদের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিবর্তন আনতে সবসময় বড় কিছু নয়, বরং ছোট ছোট উদ্যোগও যথেষ্ট। একেকটি উদ্যোগ হয়তো একেকটি জীবন বাঁচায়, আর সেই বাঁচানো জীবনই আমাদের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করে।

আরও পড়ুন