ফিল্ডস পদক পাওয়া প্রথম নারী গণিতবিদ
নাজিয়া আহমেদ নওশী
প্রকাশ: ০০:১৬, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০০:১৮, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মরিয়ম মির্জাখানি। এক বিস্ময়কর নাম, যে নামের সঙ্গে যুক্ত আছে প্রতিভা, অধ্যবসায় ও সৃজনশীলতার অনন্য কাহিনি। তেহরানের এক সাধারণ মুসলিম পরিবারে ১৯৭৭ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশব থেকেই গণিতের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ধীরে ধীরে সংখ্যার জগৎ তাকে আরো গভীরভাবে মুগ্ধ করতে শুরু করে। একসময় তিনি বুঝতে পারেন, এ জগতের সৌন্দর্য ঠিক গল্পের ভুবনের মতোই রঙিন। গণিতে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখায় প্রথম নারী গণিতবিদ হিসেবে তিনি ফিল্ডস পদক লাভ করেন, যা গণিতের নোবেল হিসেবে খ্যাত।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহ সময় পেরিয়ে যখন তার কিশোর বয়স, তখনই তিনি তেহরানের একটি বিশেষায়িত মেয়েদের স্কুলে ভর্তি হন। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মেয়েদের বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহ দিতেন। এই প্রেরণা আর শিক্ষকদের সহযোগিতায় মরিয়ম ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ পান। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেন। ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে তিনি স্বর্ণপদক জিতেন, দ্বিতীয়বার তো পূর্ণ নম্বরও অর্জন করেন। পৃথিবী তখনই জানতে পারে, নতুন এক গণিত তারকা জন্ম নিয়েছে।
তিনি শারিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেন। এখানে তার গণিতের প্রতি ভালোবাসা আরও গভীর হয়ে ওঠে। প্রতিটি সমস্যা সমাধানে তিনি অন্যদের চেয়ে ভিন্নতর পথ খুঁজতেন। তার শিক্ষকরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই মেধাবী তরুণী সাধারণ গবেষকের কাতারে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ১৯৯৯ সালে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মরিয়ম মির্জাখানি বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ কার্টিস ম্যাকমুলেনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করেন। তার পিএইচডি থিসিস ছিল জটিল জ্যামিতি নিয়ে, ‘সিম্পল জিওডেসিকস অন হাইপারবোলিক সারফেসেস অ্যান্ড দ্য ভলিউম অব মোডুলি স্পেস অব কার্ভস’। শিরোনাম শুনলেই বোঝা যায়, বিষয়টি ছিল ভীষণ কঠিন ও দুর্বোধ্য। অথচ তিনি এত সূক্ষ্মভাবে কাজটি করেছিলেন যে, বিশ্বের নামকরা গণিতবিদরা বিস্মিত হয়েছিলেন। এটাকে বলা হয় এমন এক অবদান, যা পরবর্তী প্রজন্মের গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
গবেষণা শেষ করে তিনি কিছুদিন প্রিন্সটনে শিক্ষকতা করেন। অল্প বয়সেই তার গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং প্রতিটি লেখাই গণিতজগতে আলোচনার জন্ম দেয়। ২০০৮ সালে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এ বয়সে এমন কৃতিত্ব খুব কম গণিতবিদই অর্জন করতে পেরেছেন।
মরিয়ম মির্জাখানির কাজের মূল কেন্দ্র ছিল রিমান সারফেস এবং তার মোডুলি স্পেস। তিনি শুধু সমাধান খুঁজতেন না, সমস্যাকে নতুনভাবে দেখার সাহস রাখতেন। অন্যরা যেখানে প্রচলিত পথে হেঁটেছেন, তিনি সেখানে নিজের আঁকা মানচিত্রে নতুন পথ তৈরি করেছেন।
২০১৪ সাল ছিল তার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়। সেই বছর তিনি পান গণিতের নোবেল খ্যাত ফিল্ডস মেডেল। ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে এই পুরস্কার অর্জন করে তিনি প্রমাণ করেন, গণিত শুধু পুরুষের ক্ষেত্র নয়। প্রথমবারের মতো কোনো ইরানি এই স্বীকৃতি অর্জন করেন, যা ছিল ইরানি জাতির জন্য এক বিশাল গৌরব। তার নাম ঘোষণা করার পর বিশ্ব গণিত সমাজে যে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিল, তা এখনো স্মরণীয়।
তবে এই গৌরবময় যাত্রার মাঝেই অন্ধকার এসে ভর করে। ২০১৩ সালে তার শরীরে ধরা পড়ে স্ক্যান্সার। চিকিৎসা চলতে থাকে, তবুও তিনি থেমে থাকেননি। হাসপাতালে থেকেও নোটবুকে আঁকিবুঁকি করেছেন, সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সারা বিশ্বে। বিজ্ঞান ও গণিতজগৎ এক অমূল্য রত্ন হারায়।
তার মৃত্যুর পর তাকে স্মরণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ইরানে তার জন্মদিনকে আন্তর্জাতিক নারী গণিত দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার নামে বৃত্তি ও গবেষণা পুরস্কার চালু হয়েছে। ক্ষুদ্রগ্রহ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, সবখানেই তার নাম এখন অমর হয়ে আছে।
মরিয়ম মির্জাখানির জীবন এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি দেখিয়ে গেছেন, প্রতিকূলতা যত বড়ই হোক, প্রতিভা আর অধ্যবসায় থাকলে শিখরে পৌঁছানো যায়। একজন নারী, যিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বেড়ে ওঠেন, বইপড়ায় ভালোবাসেন, ধীরে ধীরে সংখ্যার বিমূর্ত জগতে ডুবে গিয়ে হয়ে ওঠেন পৃথিবীর সেরা গণিতবিদদের একজন, এ কাহিনি আসলে শুধু গণিতের নয়, মানবসম্ভাবনারও।
আজও তার নাম উচ্চারণ করলে তরুণীরা নতুন স্বপ্ন দেখতে শেখে। গণিত নামের কঠিন জগতটিকে তিনি সৌন্দর্যের এক নতুন রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। তার হাত ধরে বহু কন্যাশিশু বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তারাও একদিন বিজ্ঞান ও জ্ঞানের মহাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠতে পারে। মরিয়ম মির্জাখানি চলে গেছেন, কিন্তু তার জীবনগাথা রয়ে গেছে অনন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়