হরিপুরের তরুণদের সমাজ বদলের গল্প
প্রজন্ম ডেস্ক, সমাজকাল
প্রকাশ: ০১:১৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য তরুণ রয়েছে, যারা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখে। সীমান্তবর্তী ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলা সেটার এক অনন্য উদাহরণ। এখানকার কিছু তরুণ পরিবেশ রক্ষা, শিক্ষা বিস্তার আর মানবিক উন্নয়নের দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
এই তরুণদের বিশ্বাস, প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবেসে যদি সমাজ গড়ে তোলা যায়, তবেই সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব। সেই বিশ্বাস থেকেই গড়ে উঠেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘অক্সিজেন’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সংগঠনটি গাছ লাগানো, জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া এবং মানবিক সহায়তার নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
সংগঠনটির সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হচ্ছে ‘লাল-সবুজ নগরী’ গড়া। তাই তারা হাজার হাজার কৃষ্ণচূড়া, নিম ও তালগাছ রোপণ করছে। বর্ষায় নিয়মিত গাছ লাগানোকে তারা আবশ্যিক কাজ হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম ফুল আর সবুজ পাতার মিশেলে তারা হরিপুরের পথে ঘাটে বাংলাদেশের পতাকার জীবন্ত রূপ ফুটিয়ে তুলতে চায়। বজ্রপাত প্রতিরোধের জন্য তারা তালগাছ রোপণ করে, পরিবেশ সুরক্ষায় নিমগাছ লাগায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভেষজ বাগান তৈরি করে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ সংরক্ষণের কাজও তারা করে যাচ্ছে। একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘নিম সড়ক’, যেখানে সারি সারি নিমগাছ দাঁড়িয়ে আছে।
তবে ‘অক্সিজেন’-এর কার্যক্রম শুধু গাছরোপণেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা সীমান্ত অঞ্চলের শিক্ষাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের জন্য গড়ে তুলেছে ‘ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার’। সেই পাঠাগারে বই পড়ে তারা নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করে।
সংগঠনটি বিনা মূল্যে সেলাই মেশিন বিতরণ করছে, বেকারদের ছোট দোকান গড়ে তুলতে সহায়তা দিয়েছে, নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসচেতনতা কর্মসূচি করছে, বৃদ্ধদের শিক্ষার সুযোগ তৈরি করছে, এমনকি মহল্লায় মহল্লায় টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছে যাতে মানুষ সুপেয় পানি পায়। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ‘অক্সিজেন’ পাশে থাকে, অগ্নিকাণ্ডে ঘর হারানোদের জন্য নতুন ঘর তৈরি করে, হুইলচেয়ার দিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সহায়তা করে এবং মসজিদে অজুখানাও নির্মাণ করে দেয়।
মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা ত্রাণ বিতরণ করেছে বন্যার সময়, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে, দেয়ালচিত্র এঁকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেছে, শীতে দরিদ্র মানুষদের মাঝে কম্বল বিতরণ করেছে এবং জঙ্গিবাদ ও মাদকবিরোধী সচেতনতাও ছড়িয়েছে। সংগঠনের তরুণ সদস্যরা বলেন, সংখ্যায় তারা কম হলেও মনোবল অনেক বেশি। তারা বিশ্বাস করেন, অক্লান্ত প্রচেষ্টায় একদিন গড়ে উঠবে এমন এক সমাজ যেখানে মানুষ হবে মানবিক, প্রকৃতিকে ভালোবাসবে এবং ন্যায়ের পথে হাঁটবে।
আমাদের দেশের প্রতিটি গ্রাম ও মহল্লায় যদি ‘অক্সিজেন’-এর মতো সংগঠন গড়ে ওঠে, তবে উন্নয়নের গতি বাড়বে। পরিবেশ রক্ষা থেকে শুরু করে শিক্ষা বিস্তার, দারিদ্র্য বিমোচন থেকে মানবিক সহায়তা, সব ক্ষেত্রেই এমন তরুণদের স্বেচ্ছাশ্রম সমাজকে এগিয়ে নেবে নতুন পথে। তরুণদের এই স্বপ্ন ও পরিশ্রম পুরো জাতির জন্যই অনুপ্রেরণা হতে পারে। কারণ রাষ্ট্র গড়ে ওঠে ছোট ছোট সমাজের হাত ধরে, আর সমাজ গড়ে ওঠে সচেতন নাগরিকের উদ্যোগে। তাই প্রতিটি এলাকায় যদি ‘অক্সিজেন’-এর মতো একটি করে সংগঠন থাকে, তবে বাংলাদেশ সত্যিই হয়ে উঠবে প্রকৃত অর্থে লাল-সবুজের মানবিক স্বর্গভূমি।