দীপাবলির সকালে মোদীর বার্তা
অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪:০৪, ২০ অক্টোবর ২০২৫

ছবি: সংগৃহীত
দীপাবলির সকালেই ঘোষণা করলেন—“অপারেশন সিঁদুরের সময় পাকিস্তানের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের স্বদেশি বিক্রান্ত।”
এই বার্তা শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয়; এটি ভারতের সামরিক আত্মনির্ভরতার এক প্রতীকী ঘোষণাও বটে। কারণ, ২১ শতকের এই পর্যায়ে যখন প্রতিরক্ষা শিল্পে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ ক্রমে বাস্তব রূপ নিচ্ছে, তখন বিক্রান্ত, ব্রহ্মস, আকাশ—সবই মিলিতভাবে এক নতুন যুগের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আইএনএস বিক্রান্ত: প্রযুক্তি ও শক্তির সংমিশ্রণ
ভারতের প্রথম স্বদেশি বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্ত নৌবাহিনীর জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।কোচি শিপইয়ার্ডে তৈরি এই জাহাজটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে, আর আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশন করা হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে।এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬২ মিটার, উচ্চতা ৬০ মিটার, ওজন ৪৫,০০০ টনের বেশি।
একসঙ্গে ৩০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার বহন করতে পারে এটি—যার মধ্যে রয়েছে মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমান, কেমভ-৩১ এইডব্লিউ হেলিকপ্টার এবং ভারতের তৈরি এইচএএল ধ্রুভ হেলিকপ্টার।
জাহাজটি সম্পূর্ণরূপে স্টোবার প্রযুক্তিতে নির্মিত, যা রাশিয়ার কুজনেৎসোভ বা চীনের লিয়াওনিং–এর মতোই উন্নত মানের।
ভারতীয় নৌবাহিনীর ভাষায়, বিক্রান্ত এখন শুধুই একটি যুদ্ধজাহাজ নয়—এটি ‘মোবাইল এয়ারবেস’, অর্থাৎ সমুদ্রেই যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করার সক্ষমতা।
ব্রহ্মস ও আকাশ: স্বদেশি ক্ষেপণাস্ত্রের সাফল্য
মোদীর বক্তব্যে উঠে এসেছে দুটি মূল অস্ত্রের নাম—ব্রহ্মস ও আকাশ।
এই দুই ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উৎপাদন সক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন।
রাশিয়া ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্রের গতি শব্দের চেয়ে তিনগুণ । এটি স্থল, সমুদ্র ও আকাশ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য।
অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলিতে আঘাত হানার সময় এই ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল বলে সরকারি সূত্রে উল্লেখ আছে।
এর নিখুঁত লক্ষ্যভেদ ক্ষমতা ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া সামর্থ্যই একে বিশ্বের অন্যতম মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আকাশ’ ভারতের নিজস্বভাবে তৈরি সারফেস-টু-এয়ার (এসএএম) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা ২৫ কিমি দূরের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সক্ষম।
এই ক্ষেপণাস্ত্র এখন ভারতীয় বিমানবাহিনী ও স্থলবাহিনীর হাতে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং এর এক্সপোর্ট সংস্করণ ইতিমধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর আগ্রহ কেড়েছে।
‘অপারেশন সিঁদুর’: এক প্রতীকী অভিযান
মোদীর বক্তৃতায় উল্লিখিত ‘অপারেশন সিঁদুর’ গত মে মাসে পরিচালিত হয়—যখন ভারত সীমান্তের ওপারে সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করে।যদিও এই অভিযানের পুরো তথ্য গোপন রাখা হয়েছে, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে এটি ছিল ভারতের এক সমন্বিত ত্রিবাহিনী অভিযান—যেখানে নৌ, বায়ু ও স্থলবাহিনী একসঙ্গে কাজ করে।
এই অভিযানে ‘ব্রহ্মস’ ও ‘আকাশ’ ছাড়াও ড্রোন নজরদারি ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম ব্যবহার হয়।সেই সময় পাকিস্তান প্রশাসন একাধিক সীমান্ত অঞ্চলে সতর্কতা জারি করেছিল, যা ভারতের সামরিক শক্তির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবেরই ইঙ্গিত।
মোদীর বার্তা: আত্মনির্ভর ভারতের প্রতিরক্ষা নীতি
মোদী বলেছেন, “আমাদের জওয়ানরা এই দেশের মাটিতেই জন্মেছে, তাই তাদের সুরক্ষার অস্ত্রও দেশের মাটিতে তৈরি হওয়া উচিত।”
এই বক্তব্য প্রতিফলিত করে তার বহু পুরনো প্রতিরক্ষা কৌশল—‘আত্মনির্ভর ভারত’।তিনি দাবি করেছেন, গত ১১ বছরে প্রতিরক্ষা উৎপাদনে ৩০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি হয়েছে এবং এখন প্রতি ৪০ দিনে একটি নতুন যুদ্ধজাহাজ বা সাবমেরিন নৌবাহিনীতে যুক্ত হচ্ছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানি ইতিমধ্যেই ২.৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে—যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ ভারতীয় অস্ত্রের ক্রেতা।
প্রযুক্তি, কূটনীতি ও প্রতিরোধ শক্তি
বিক্রান্ত ও ব্রহ্মস শুধু সামরিক সক্ষমতার প্রতীক নয়; তারা ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানকেও শক্তিশালী করছে।
ভারতের কৌশল এখন "ডিটারেন্স বাই ক্যাপাবিলিটি"—অর্থাৎ যুদ্ধ নয়, বরং সক্ষমতা দেখিয়েই প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত কোয়াড জোট (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের কৌশলগত মিত্রতা)–এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছে।
আইএনএস বিক্রান্তের মতো যুদ্ধজাহাজ ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
আত্মনির্ভরতার অর্থ কেবল দেশীয় কারখানায় অস্ত্র তৈরি নয়; বরং প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি সক্ষমতা , গবেষণার স্বনির্ভরতা—এই চারটি স্তম্ভের সমন্বয়ে টেকসই সামরিক শক্তি গড়ে ওঠে।
ভারত যদি সত্যিকার অর্থে ‘আত্মনির্ভর সেনাবাহিনী’ গড়ে তুলতে চায়, তবে তাকে প্রতিরক্ষা খাতে বিশ্বমানের গবেষণা ও উৎপাদন নেটওয়ার্ক গড়তে হবে।
বর্তমানে ডিআরডিও, এইচএএল , বিইএল এবং কোচি শিপইয়ার্ড এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
দীপাবলির সকালে সামরিক পোশাকে মোদীর উপস্থিতি নিছক প্রতিরক্ষা বার্তা নয়—এটি রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে এটি এক প্রকার জাতীয়তাবাদী প্রতীকী বার্তা, যেখানে আত্মনির্ভরতা, প্রযুক্তি এবং সেনা–এই তিন শব্দ একসঙ্গে গেঁথে গেছে ভোট-রাজনীতির মঞ্চেও।
অপারেশন সিঁদুরকে সামনে রেখে পাকিস্তানের প্রতি কৌশলগত বার্তা এবং দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান—দুটিই এই বক্তৃতার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য।