প্রথমবারের মতো বৈঠকের দৃশ্য ধারণ
নোবেল শান্তি পুরস্কারের অন্তরালে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫:৪০, ৯ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০১:০২, ১১ অক্টোবর ২০২৫

ছবি : বিবিসি
বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারগুলোর একটি—নোবেল শান্তি পুরস্কার—নিয়ে যেমন থাকে রহস্য, তেমনি থাকে বিতর্কও। ১৯০১ সাল থেকে প্রতি বছর গোপনে সিদ্ধান্ত নেন নরওয়ের নোবেল কমিটির পাঁচ সদস্য। কিন্তু এবার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিবিসি ও নরওয়ের জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমকে অনুমতি দেওয়া হয়ে সেই বৈঠকের দৃশ্য ধারণের।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে এ নিয়ে বিস্তারিত জানা গেছে।
গোপন কক্ষের ভেতর
অসলো নোবেল ইনস্টিটিউটের সেই কক্ষে এখনো রয়েছে প্রথম দিকের ঝাড়বাতি, ওক কাঠের আসবাব ও দেয়ালে টানানো সব শান্তি পুরস্কারজয়ীর প্রতিকৃতি। দেয়ালের শেষে রয়েছে খালি জায়গা—যেখানে যুক্ত হবে এ বছরের বিজয়ীর ছবি।
সেই ঘরের একপাশে ঝুলছে আলফ্রেড নোবেলের প্রতিকৃতি, যার ১৮৯৫ সালের উইল অনুযায়ী এই পুরস্কার দেওয়া হয় “জাতিগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, স্থায়ী সেনাবাহিনী বিলোপ বা হ্রাস, কিংবা শান্তি প্রচেষ্টায় অবদানের” জন্য।
কমিটির চেয়ারম্যান ইয়োরগেন ওয়াতনে ফ্রিডনেস বিবিসিকে বলেন, “আমরা আলোচনা করি, তর্ক করি, মাঝে মাঝে উত্তাপ বেড়ে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সভ্যভাবে ঐক্যমতের সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করি।”
তবে এবারের সিদ্ধান্তের ছায়ায় একটাই নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত—ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবার চাইছেন বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি। বক্তৃতায় ও সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বারবার বলেন তিনি সাতটি যুদ্ধ ‘সমাধান’ করেছেন। দাবি করেন, “সবারই মনে হয় আমাকেই দেওয়া উচিত নোবেল।”
এমনকি মার্কিন সেনাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “তারা পুরস্কারটা দেবে এমন কাউকে, যে কিছুই করেনি—আমার সম্পর্কে বই লিখেছে মাত্র।”
তার এই আগ্রহে সাড়া দিয়েছে বিশ্বনেতারাও। ইসরায়েলের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে হোয়াইট হাউসে মনোনয়নপত্র দেখান, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট প্রশংসা করেন, এমনকি পাকিস্তান সরকারও তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনীত করেছে। এমনকি তার দূত স্টিভ উইটকফ পর্যন্ত বলেছেন, “নোবেল ইতিহাসে ট্রাম্পই সেরা প্রার্থী।”
চেয়ারম্যান ফ্রিডনেস অবশ্য বলেন, “প্রতি বছর হাজার হাজার চিঠি ও ইমেইল আসে—কাকে বেছে নেওয়া উচিত, তা জানিয়ে। তাই এই চাপ নতুন কিছু নয়।” তবে স্বীকার করেন, এবারের আন্তর্জাতিক মনোযোগ অভূতপূর্ব—“বিশ্ব এখন আলোচনা করছে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব, এটা ভালো বিষয়। কিন্তু আমাদের থাকতে হবে নীতিগতভাবে দৃঢ়।”
নোবেল কমিটি নরওয়ের পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হলেও তারা স্বাধীনভাবে কাজ করে। বর্তমান চেয়ারম্যান নিজেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংগঠনের নেতা, যিনি আগে গণমাধ্যম দমন ও ট্রাম্পের নীতির সমালোচনা করেছিলেন।
নরওয়ের গণমাধ্যম জানিয়েছে, ট্রাম্প নাকি নেটো প্রধান থেকে এখন নরওয়ের অর্থমন্ত্রী জেন্স স্টলটেনবার্গকে ফোন করে লবিং করেছেন।
প্রশ্ন উঠেছে—যদি ট্রাম্প পুরস্কার না পান, তবে তিনি কি নরওয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন? অতীতে ২০১০ সালে চীনা ভিন্নমতাবলম্বী লিউ শিয়াওবো শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর বেইজিং যেভাবে ওসলোকে অর্থনৈতিকভাবে শাস্তি দিয়েছিল, সেই আশঙ্কাই আবার উঁকি দিচ্ছে।
নিনা গ্রেগার, পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন যখন ডব্লিউএইচও ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, তখন আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে তার প্রার্থিতা দুর্বল হয়ে যায়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “প্রতিবাদ, সাংবাদিকতা ও একাডেমিক স্বাধীনতার ওপর তার দমনমূলক অবস্থান একে ‘অশান্তিপূর্ণ দিক’-এ নিয়ে যায়।”
তবে আশার কথা রাখলেন এই বিশেষজ্ঞই—“যদি ট্রাম্পের গাজা শান্তিচুক্তি সফল হয় ও টিকে থাকে, তাহলে আগামী বছর তিনি অবশ্যই প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন।”
অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতে, নোবেল পুরস্কার বিনয় ও মানবকল্যাণের প্রতীক, আত্মপ্রচার নয়। গ্রিক ছাত্র থানোস মারিজিস বলেন, “এই পুরস্কার মানবতার কল্যাণে শান্তির প্রয়াসের স্বীকৃতি—নিজের গৌরবের নয়।”
ছাত্রী ক্যাথলিন রাইট বলেন, “মালালা ইউসুফজাইয়ের মতো যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, তাদের পাশে ট্রাম্পের এই প্রচারণা হাস্যকর ও অসম্মানজনক।”
নোবেল ইনস্টিটিউটের দেয়ালে এখন পর্যন্ত চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রয়েছেন, তাদের একজন বারাক ওবামা, যিনি দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পরেই পুরস্কার পান। এ নিয়েই ট্রাম্পের ক্ষোভ—“যদি আমার নাম ওবামা হতো, আমি দশ সেকেন্ডেই পুরস্কার পেতাম।”
যুদ্ধ, বর্ণবৈষম্য, পারমাণবিক অস্ত্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাক্ষী সেই দেয়াল এবারও অপেক্ষায়—কে হবেন ২০২৫ সালের শান্তির দূত?