পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন
‘হেভেন ১’ লঞ্চের পথে
বিজ্ঞান ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫:২৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মানবজাতির মহাকাশ অভিযাত্রার ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় সূচনার অপেক্ষায়। ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভাস্ট স্পেস ঘোষণা করেছে যে তারা ২০২৬ সালের মে মাসে তাদের প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন “হেভেন১” কক্ষপথে পাঠাতে যাচ্ছে। এটি সফলভাবে উৎক্ষেপিত হলে হবে বিশ্বের প্রথম বেসরকারি মহাকাশ স্টেশন।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) প্রায় ২৫ বছর ধরে মানব সভ্যতার মহাকাশ গবেষণার প্রতীক। ২৬টি দেশের প্রায় ৩০০ মহাকাশচারী ইতিমধ্যে এই অনন্য সহযোগিতা প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে নাসা এটিকে অবসরে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় বেসরকারি খাতকে এগিয়ে এনে “নতুন প্রজন্মের মহাকাশ স্টেশন” গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
নাসা আগামী বছর একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা ডিজাইন ও অংশীদার নির্বাচন করবে। সেখানে বিজয়ী প্রতিষ্ঠান হবে ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণা ও বাণিজ্যিক অভিযাত্রার প্রধান চালিকাশক্তি।
ভাস্ট স্পেস ও হেভেন ১ প্রকল্প
হেভেন ১ একটি একক মডিউল বিশিষ্ট স্টেশন, যার ব্যাস ৪.৪ মিটার এবং বসবাসযোগ্য ভলিউম ৪৫ ঘনমিটার—প্রায় একটি সিঙ্গেল-ডেক বাসের সমান। এটি আইএসএসের মোট আয়তনের মাত্র এক-অষ্টমাংশ।
প্রথম তিন বছরে চারটি মিশন পরিচালিত হবে। প্রতিটি মিশনে চারজন মহাকাশচারী দুই সপ্তাহের জন্য অবস্থান করবেন।
লঞ্চ হবে স্পেস এক্স ফেলকন ৯ রকেটে এবং ক্রু পরিবহনে ব্যবহার হবে ক্রু ড্রাগন।
অভ্যন্তরে থাকবে ১.২ মিটার গম্বুজ জানালা, ভাঁজ করা যায় এমন টেবিল, প্রত্যেক ক্রু সদস্যের জন্য আলাদা ঘুমানোর স্থান এবং Starlink-এর মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট।
ভাস্ট স্পেস-এর সিইও ম্যাক্স হেয়ট জানান, “আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো প্রকৃত একটি মহাকাশ স্টেশন কোম্পানি হওয়া—যেখানে আমরা মহাকাশচারীদের পাঠাব, নিরাপদে ফিরিয়ে আনব এবং মহাকাশে বৈজ্ঞানিক কাজ পরিচালনা করব।”
গবেষণা ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
হেভেন ১ -এর অন্যতম আকর্ষণ হলো এর মাইক্রোগ্রাভিটি গবেষণাগার। এখানে সেমিকন্ডাক্টর, ওষুধ উৎপাদন ও ক্যান্সার শনাক্তকরণসহ নানা উচ্চপ্রযুক্তি গবেষণা পরিচালিত হবে। ভাস্ট ইতিমধ্যেই ফ্লোরিডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রেডওয়ার স্পেস এর সঙ্গে কাজ করছে, যারা পূর্বে আইএসএসে স্টেম সেল ও ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা করেছে।
প্রকল্পের বিশেষ লক্ষ্য হলো এমন দেশ ও মহাকাশ সংস্থা, যারা প্রথমবারের মতো মহাকাশচারী পাঠাতে আগ্রহী। পাশাপাশি স্ব-অর্থায়নে যেতে সক্ষম ধনী ব্যক্তিদেরও সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
ভাস্ট স্পেস একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়। নাসা একইসঙ্গে স্টারল্যাব (এয়ারবাস ও নর্থরব গ্রাম্মান-এর যৌথ উদ্যোগ), ব্লু অরিজিন এবং এক্সিওম স্পেস এর সঙ্গেও কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট আকারের প্রোটোটাইপ দিয়ে শুরু করা যথাযথ কৌশল, তবে এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের বৃহৎ পরিকল্পনার ভিত গড়ে তুলতে হবে।
মহাকাশ স্টেশন পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বর্তমানে আইএসএস পরিচালনায় দৈনিক ব্যয় প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাণিজ্যিক স্টেশন টেকসই করতে হলে এ খরচ দৈনিক ২.৭ থেকে ৫.৫ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। ভাস্ট ইতিমধ্যেই তাদের প্রতিষ্ঠাতা জেড ম্যাকলেন -এর ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ও গ্রাহক রাজস্ব মিলে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে।
হেভেন ১ কেবল একটি প্রোটোটাইপ নয়, বরং বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা ও শিল্পায়নের যুগের সূচনা। যদি ২০২৬ সালের মে মাসে সফল উৎক্ষেপণ হয়, তবে এটি হবে মানবজাতির মহাকাশ অভিযাত্রার নতুন মাইলফলক, যেখানে বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাবনা একসঙ্গে উন্মুক্ত হবে।