মানব মমির সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন মিলল এশিয়ায়
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬:৪৭, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৯:২৩, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চীনের গুয়াংসি প্রদেশের নাননিং শহরের হুইয়াওতিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল থেকে পাওয়া মধ্যবয়সী পুরুষ কঙ্কালটির বয়স ৯ হাজার বছরেরও বেশি। ছবি: সিএনএন
প্রায় ১৪ হাজার বছর আগে প্রাচীন এশিয়ার কিছু অঞ্চলের শিকারি-সংগ্রাহকরা সমাহিত করার আগে মৃতদেহ বিশেষভাবে ধোঁয়া দিয়ে শুকিয়ে নিতেন। নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, এগুলোই এখন পর্যন্ত পাওয়া মানবদেহ মমি করার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন।
বিশ্বজুড়ে নানা সমাজে দেহ সংরক্ষণের (মমি) নানান রীতি প্রচলিত ছিল। এক্ষেত্রে কেউ লবণ, কেউ ধোঁয়া, কেউ তাপ, কেউ হিমায়ন বা রাসায়নিক প্রলেপ ব্যবহার করত, যাতে দেহের নরম অংশ শুকিয়ে পচন ঠেকানো যায়। তবে চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার যেসব দেহাবশেষ পরীক্ষা করা হয়েছে, সেগুলো সরাসরি মমি করা বলে মনে হয়নি। কিন্তু গবেষকরা এসব মৃতদেহের হাড়ে পোড়া চিহ্ন দেখেছেন—যা প্রমাণ করে এগুলো দীর্ঘ সময় ধরে অল্প তাপে রাখা হয়েছিল, ফলে দেহ শুকিয়ে গিয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় ভেতরের আর্দ্রতা দূর করে দেহগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল।
সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৃতদেহ ধোঁয়ায় শুকানোর এই প্রক্রিয়া আজও পাপুয়া নিউগিনির কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এশীয় সমাধিস্থলে পাওয়া প্রাচীন কঙ্কালগুলোর ভাঁজ করা ‘কুঁকড়ে বসা’ ভঙ্গি আধুনিক ধোঁয়া-শুকানো মমির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এ থেকে অনুমান করা হচ্ছে, সেগুলোও একই প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
এর আগে মানবদেহ মমি করার প্রাচীনতম উদাহরণ ছিল চিলির উত্তরাঞ্চলের চিনচোরো সংস্কৃতিতে (প্রায় ৭ হাজার বছর আগে) এবং প্রাচীন মিসরে (প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে)। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন এই আবিষ্কার ইতিহাসকে কয়েক হাজার বছর পেছনে ঠেলে দিল।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. হসিয়াও-চুন হাং বলেন, “এই প্রথা মানুষের কালজয়ী আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে—পরিবার ও প্রিয়জনদের মৃত্যুর পরও যেন ‘একসাথে’ রাখা যায়।”
জটিল বিশ্বাসের ইঙ্গিত
তুরস্কের বিলকেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. এমা বেসাল বলেন, “এটি (আবিষ্কার) প্রমাণ করে শিকারি-সংগ্রাহকদেরও মৃত্যুর পর দেহ সংরক্ষণ নিয়ে জটিল ধারণা ও বিশ্বাস ছিল।”
গবেষণায় ১১টি স্থানে পাওয়া ৫৪টি কুঁকড়ে বসা ভঙ্গির সমাধি পরীক্ষা করা হয়। নমুনাগুলো দক্ষিণ চীন, উত্তর ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ থেকে পাওয়া। এর বাইরে মালয়েশিয়া, জাভা ও ফিলিপাইনে একই ধরনের সমাধি পাওয়া গেলেও সেগুলো এ গবেষণার অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
ভিন্ন ভঙ্গির ব্যাখ্যা
প্রাচীন এই কঙ্কালগুলোর অস্বাভাবিক ভঙ্গি দীর্ঘদিন বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছিল। জাপানের সাপ্পোরো মেডিকেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হিরোফুমি মাতসুমুরা প্রথম ইঙ্গিত দেন, এগুলো স্বাভাবিকভাবে এমন হয়নি—বরং কৃত্রিমভাবে ভাঁজ করে রাখা হয়েছিল।
হাড়ে দেখা গেছে আংশিক দগ্ধ অংশ, বিশেষ করে কনুই, খুলি ও পায়ের হাড়ে। এগুলো পাতলা মাংসপেশিতে ঢাকা অংশ হওয়ায় ধোঁয়া-তাপে সহজে পোড়ার সম্ভাবনা থাকে।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল
বেশিরভাগ কঙ্কালে পোড়ার দৃশ্যমান দাগ না থাকায় বিজ্ঞানীরা উন্নত পরীক্ষা চালান। এক্সরে ডিফ্র্যাকশন ও ফোরিয়ার-ট্রান্সফর্ম ইনফ্রারেড স্পেকট্রোস্কোপি দ্বারা দেখা যায়, ৮৪% নমুনায় অল্প তাপের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছিল।
এ থেকে ধারণা করা হয়, মৃতদেহকে কুঁকড়ে বসানো ভঙ্গিতে রেখে ধোঁয়ার ওপরে শুকানো হতো, পরে মাটির গর্ত বা গুহায় সমাধিস্থ করা হতো।
সবচেয়ে পুরনো উদাহরণ
নতুন গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৯টি স্থানের হাড়ে ধোঁয়া-শুকানোর প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে প্রাচীনতমটি ভিয়েতনামের একটি স্থানের হাতের হাড়, যার বয়স প্রায় ১৪ হাজার বছর। বেশিরভাগ নমুনা ১২ হাজার থেকে ৪ হাজার বছরের পুরনো।
সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও প্রযুক্তির মিশ্রণ
ড. হাং বলেন, “আমাদের গবেষণা দেখায়, সেই সময়েও প্রযুক্তি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের এক অসাধারণ সমন্বয় ছিল। দক্ষিণ চীন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত এই প্রথা হাজার বছরেরও বেশি টিকে থেকেছে।”
গবেষকরা বলেন, আর্দ্র পরিবেশে দেহ সংরক্ষণে ধোঁয়া-শুকানোই ছিল সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। এতে কয়েক মাস সময় লাগত, আর পরিবারকে নিয়মিত দেহের পাশে থাকতে হতো—যা নিছক আচার নয়, গভীর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক প্রতিশ্রুতির প্রতীক।
পরিশেষে ড. হাং বলেন, “নিওলিথিক যুগে ও তার আগে এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক অনুরাগ ও গভীর ভালোবাসার মাধ্যমেই সম্ভব ছিল।”
মূল প্রতিবেদন : সিএনএন