বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫

| ৬ কার্তিক ১৪৩২

ইউনেসকোর ‘রন্ধনশিল্প নগরী’র তালিকাভুক্ত ১১টি শহর

জীবনযাপন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১:০৫, ২২ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০৩:১৬, ২২ অক্টোবর ২০২৫

ইউনেসকোর ‘রন্ধনশিল্প নগরী’র তালিকাভুক্ত ১১টি শহর

ভ্রমণপিপাসুরা প্রায়ই ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। কিন্তু ইউনেসকোর ‘সিটি অব গ্যাস্ট্রনমি’ অর্থাৎ ‘রন্ধনশিল্পের নগরী’ তালিকাভুক্ত শহরগুলোর সম্পর্কে খুব কম লোকই জানেন। বিশ্বে এমন কিছু শহর রয়েছে যেখানে ভ্রমণ গন্তব্য হয়েছে শুধুমাত্র খাবারের জন্যই।

একটি দেশের খাবার শুধু ক্ষুধাই মেটায় না, বরং বলে দেয় সেই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর মানুষের জীবনযাপন। পৃথিবীর এমন কিছু শহর আছে যেগুলো তাদের অনন্য রন্ধন ঐতিহ্যের জন্য পেয়েছে ইউনেসকোর স্বীকৃতি। শুধু খাবার চেখে দেখা নয়, বরং এই শহরগুলোতে ভ্রমণ এক প্রকার সাংস্কৃতিক যাত্রা। খাবারের প্রতিটি পদে লুকিয়ে থাকে স্থানীয় স্বাদ, কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সৃজনশীলতা এবং মানুষের গল্প বলার এক শিল্প। চলুন জেনে নেই খাবারের জন্যই ভ্রমণের গন্তব্য হয়ে উঠা বিশ্বের এমন ১১টি শহর।

টাকসন, যুক্তরাষ্ট্র

দশ বছর আগে ইউনেসকো গ্যাস্ট্রোনমি সিটির মর্যাদা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার টাকসন। এখানকার খাবারে পাবেন তোহোনো ও’ওধাম আদিবাসীদের চার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী, মেক্সিকান মসলার ঘ্রাণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকান ধাঁচ। এ ছাড়া চিল্টেপিন মরিচের তৈরি চকলেট, ‘হুইস্কি ডেল বাকে মেসকুইট স্মোকড হুইস্কি’র স্বাদ। শহরের রন্ধনশিল্পীদের পরিবেশনা যেন হাজার বছরের পুরোনো আদিবাসী ও মেক্সিকান খাবারের মিলনমেলা।

হেরাকলিওন, গ্রিস

ক্রিট দ্বীপের শহর হেরাকলিওনের রন্ধনশিল্প খুব সাধারণ হলেও ইতিহাসে ভরপুর। এখানে রয়েছে ৩০ মিলিয়ন বা  ৩ কোটি জলপাই গাছ। আর ডালিম, কলা ও ডুমুর। ‘ক্রিটান গ্রাভিয়েরা’ নামের হলদে পনির, সেদ্ধ মাংসের ‘আন্টিক্রিস্তো’র অতুলনীয় স্বাদ। স্থানীয় জলপাই তেলের খাবারের জন্য বিখ্যাত ‘রেস্তোরাঁ পেসকেসি’। আর ‘কাফেনিও’ এবং ‘টেম্পেলিস’ জনপ্রিয় তার মৌসুমি টাপাস পরিবেশনে।

বার্গেন, নরওয়ে

হাজার বছরের পুরোনো নরওয়ের বার্গেন শহরের রন্ধন ঐতিহ্য। সেই ভাইকিং যুগের মাছ রান্না এবং সংরক্ষণের কৌশল এখনো জনপ্রিয়। কড মাছের লবণ-চিনিতে সংরক্ষিত ‘পারসেটরস্ক’ এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার। এ ছাড়া ‘লাইসভেরকেট’, ‘গাপট্রাস্ট’ এবং ‘ওমাকাসে বাই সেরগে পার্ক’ রেস্তোরাঁগুলো বার্গেনের গর্ব। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে এ শহরে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল রন্ধন মেলা ‘বার্গেন ম্যাটফেস্টিভাল’।

ফ্লোরিয়ানোপোলিস, ব্রাজিল

‘ব্রাজিল’স অয়েস্টার ক্যাপিটাল’ বলা হয় দেশটির সান্তা ক্যাটারিনা দ্বীপের ফ্লোরিয়ানোপোলিসকে। কারিজো এবং আজোরিয়ান জনগোষ্ঠীর প্রভাবে গড়ে উঠেছে এক বৈচিত্র্যময় খাবারের জগৎ। সমুদ্রের শামুক, স্কুইড, অক্টোপাস এবং চিংড়ির মিশেলে তৈরি হয় বিখ্যাত সি-ফুড ‘স্ট্যু কালদেইরাদা’। স্থানীয় শেফ দানিয়েলা দামাসেনো বলেন, ‘এই পদই ফ্লোরিয়ানোপোলিসের গ্যাস্ট্রোনমির প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।’

ফুকেট, থাইল্যান্ড

ফুকেট হলো থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ—চীনা, থাই, মুসলিম ও ভারতীয় রান্নার এক বৈচিত্র্যময় মিলনমেলা। স্থানটি ২০১৫ সালে ইউনেসকো গ্যাস্ট্রোনমি সিটির স্বীকৃতি পায়। এখানকার রেস্তোরাঁ ‘প্রু’ স্থানীয় উপকরণে তৈরি মৌসুমি মেনুর জন্য বিখ্যাত। আর ঐতিহ্যবাহী রান্না শেখার সেরা জায়গা 'ব্লু এলিফ্যান্ট'।

বেন্ডিগো, অস্ট্রেলিয়া

ভিক্টোরিয়ার পুরোনো সোনার খনি এই শহর আজ স্থানীয় খাদ্যসংস্কৃতির এক নতুন কেন্দ্র। ডিজোকিটজের উদ্যোগে ‘দজা দজা ওয়ারুং’ জনগোষ্ঠীর প্রাচীন কৃষিপদ্ধতি এবং পেপারগ্রিন ফার্মে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের কৃষিশিক্ষা দেওয়া শহরের ঐতিহাসিক ভবনগুলোয় এখন আধুনিক রেস্তোরাঁ। আর ‘বেন্ডিগো ব্রিউইং’ ও ‘শিরাজ রেপাবলিক’ জনপ্রিয় পানীয়ের ঠিকানা।

সান্তা মারিয়া দ্য ফেইরা, পর্তুগাল

মিষ্টি রুটির জন্য ‘ফোগাসা’ ও প্রাচীন ‘ফোগাসেইরাস ফেস্টিভ্যাল’ বিশ্বখ্যাত। প্রতি বছর মধ্যযুগীয় উৎসব ‘মিডিভাল জার্নিতে’ পরিবেশিত হয় পুরোনো রেসিপির খাবার। স্থানীয় ‘কাসা দা এস্তাসাও’ রেস্তোরাঁর মাংসের স্টেক আর ‘টেরা মা’র তাজা মাছ দারুণ জনপ্রিয়। শেফ সারা সান্তোস বলেন, “ধীরে ধীরে সেদ্ধ কচি ছাগলের মাংস ‘রোস্ট কাবরিতো’, আমাদের উৎসবের প্রাণ।"

বারগামো, ইতালি

উত্তর ইতালির বারগামোতে ‘পার্কো দে কোল্লি’ উদ্যোগ স্থানীয় কৃষকদের শহরের ভেতরেই চাষাবাদের সুযোগ দিয়েছে। হর্টাস রেস্তোরাঁয় চেখে দেখা যায় ‘মারিনেটেড সালমন সাশিমি’ ও ‘টেরিয়াকি সসে’র অনন্য সংমিশ্রণ। মধ্যযুগীয় থিমে প্রতি বছর আয়োজিত ভোজসভা পর্যটক আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

ফ্রিবুর্গ, সুইজারল্যান্ড

বছরের প্রতি অক্টোবরে ‘বেনিশোঁ’ উৎসবে দেওয়া হয় মধুর আদা-রুটি ‘বিসকোম’। আর ডিসেম্বরের সেন্ট নিকোলাস দিবসে স্থানীয় দুধের পনির ‘ভাশেরিন ফ্রিবুরগোইস’ পরিবেশিত হয়। ‘লা শ্‌ভাইজারহালে কফে’র মেনুতে ‘ক্রোক-মসিয়র’ এবং ‘মেরিং ডেজার্ট’ স্থানীয় উপকরণের সেরা উদাহরণ।

হাতায়, তুরস্ক

সিল্ক রোডের পুরোনো বাণিজ্যকেন্দ্র হাতায় এ খাবারের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে ভূমধ্যসাগরীয়, আনাতোলীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের স্বাদে। টক, ঝাল ও মিষ্টির সুষম মিশ্রণই এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। স্থানীয় জলপাই তেলের ‘হুমাস’ কিংবা সিরাপ মাখানো চিজ পেস্ট্রি ‘কুনাফে’—সবই মুখরোচক। নদীর তীরের ‘সুলতান সফরাসি’ রেস্তোরাঁয় কুনাফের স্বাদ নিতে ভিড় করেন ভোজনরসিকেরা।

তসুরোকা, জাপান

ইয়ামাগাতা প্রিফেকচারের এই শহরটি চেরি ফুলের শহর হিসেবে প্রসিদ্ধ, আবার রন্ধনরাজ্যও বটে। শোনাই সমভূমি ও জাপান সাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় এখানকার খাবারের রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। বসন্তের পাহাড়ি শাক ‘সানসাই’ আর গ্রীষ্মের ‘দাদাচা-মামে’ সয়াবিন, স্থানীয়দের কাছে যেন অমৃত। পাহাড়ের যামাবুশি পুরোহিতদের নিরামিষ খাদ্যপদ্ধতি ‘শোজিন রিওরি’ এখন বিশ্বখ্যাত।

খাবার শুধু পেট ভরায় না বরং, মানুষ, সংস্কৃতি এবং সময়ের গল্পও বলে। ইউনেসকোর স্বীকৃত এই ১১টি শহরে ভ্রমণের সঙ্গে পাবেন ঐতিহাসিক খাবারের স্বাদ।

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন