ভাস্কর্যের ভাষায় ইতিহাস বলার কারিগর : হামিদুজ্জামান
সমাজকাল
প্রকাশ: ১৩:৫৪, ২০ জুলাই ২০২৫

ভাস্কর্যের ভাষায় ইতিহাস বলার কারিগর : হামিদুজ্জামান
সমাজকাল ডেস্ক
বাংলাদেশের শিল্প ও ভাস্কর্যের ইতিহাসে যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তাদের অগ্রগণ্য একজন হলেন হামিদুজ্জামান খান। তার ভাস্কর্যে যেমন আছে মুক্তিযুদ্ধের গর্ব, তেমনি আছে নিসর্গের কোমলতা, আছে মানবশরীরের অভিব্যক্তি, আবার আছে বিমূর্ততার নান্দনিকতা। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাস্কর্যচর্চার বিকাশে তিনি রেখেছেন অনন্য অবদান। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তার ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও জাপানের মতো দেশে।
জন্ম থেকে শিল্পযাত্রা
১৯৪৬ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার সহশ্রাম ধুলদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হামিদুজ্জামান। শৈশবেই আঁকাআঁকির প্রতি প্রবল আকর্ষণ জন্ম নেয় তার। ছাত্রজীবনে আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। পরবর্তীতে ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে স্নাতক শেষ করেন ১৯৬৭ সালে। এরপর ভারতের বরোদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে মেটাল কাস্টিংয়ের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় আবেগ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার শিল্পচেতনায় গভীর রেখাপাত করে। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে ‘একাত্তর স্মরণে’, ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’, ‘দরজা’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এবং সবচেয়ে আলোচিত ‘সংশপ্তক’ শীর্ষক ভাস্কর্য তৈরি করেন, যা আজও দেশের মানুষের গর্ব ও অনুপ্রেরণার প্রতীক।
‘সংশপ্তক’ - জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত এই ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য একজন একহাত একপা হারানো মুক্তিযোদ্ধাকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটে চলতে দেখায়। এটি শুধু শিল্প নয়, এটি একটি জাতির আত্মত্যাগের প্রতীক।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও স্বীকৃতি
১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল অলিম্পিক ভাস্কর্য পার্কে ‘Steps’ নামের একটি কপার ভাস্কর্য স্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে তার কাজ প্রশংসিত হয়। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক তার তিনটি চিত্রকর্ম কিনে ওয়াশিংটনের প্রধান দপ্তরে স্থাপন করে। ২০০৬ সালে ভাস্কর্যে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।
চিত্রকর্মেও সাফল্য
যদিও হামিদুজ্জামান ভাস্কর হিসেবে বেশি পরিচিত, তার জলরঙ ও অ্যাক্রিলিক চিত্রকর্মও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে। হাওড়, নদী, পাখি, গ্রামীণ নিসর্গ, পাহাড় ইত্যাদি বিষয়কে তিনি বিমূর্ত ও মিতবাক রূপে তুলে ধরেছেন তার ক্যানভাসে। শিল্পাচার্য জয়নুল একবার বলেছিলেন, “জলরঙ কখনও ছেড়ে দিও না হামিদ, এটাই একদিন তোমাকে বহুদূর নিয়ে যাবে।” সেই ভবিষ্যদ্বাণী যেন শতভাগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
স্থাপনাভিত্তিক ভাস্কর্য
বাংলাদেশ ব্যাংক, ইউনাইটেড ভবন, বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথ, ঢাকা সেনানিবাস, রোজ গার্ডেন – এমন বহু স্থানে হামিদের ভাস্কর্য স্থাপিত আছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার “শান্তির পায়রা” – যা ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে স্থাপিত হয়।
ভাস্কর্য পার্ক ও উত্তরাধিকার
২০১৮ সালে গাজীপুরে সামিট গ্রুপের সহায়তায় হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রায় ২০টি স্থায়ী ভাস্কর্য, স্থাপনা ও চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। এটি বাংলাদেশের শিল্পচর্চার জন্য একটি স্থায়ী নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।
শিল্পচেতনার বৈশিষ্ট্য
হামিদের কাজে এক্সপ্রেশনিজম, মিনিমালিজম, বিমূর্ততা ও স্থাপত্যিক ফর্মের মিশ্রণ দেখা যায়। তার মতে, ফর্মের নিরীক্ষা এবং উপকরণের অন্তর্গত স্বভাব আবিষ্কার করাটাই একটি শিল্পীর প্রধান কাজ। শিল্প-সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদের ভাষায়, “হামিদ প্রধানত গতিরই শিল্পী – তার ফর্ম যেন সবসময় চলমান, উত্তরণের দিকে ধাবিত।”
ব্যক্তিজীবন
১৯৭৬ সালে হামিদ আইভি জামানকে বিয়ে করেন, যিনি নিজেও একজন ভাস্কর ও শিল্পী। তাদের দুই ছেলে কপার ও জারিফ শিল্প ও সৃজনশীল পরিবেশেই বড় হয়েছেন।
ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম ও নান্দনিক শিল্প-দর্শনের একটি বিরল যুগলবন্দি দেখা যায় হামিদুজ্জামান খানের কাজগুলোতে। একজন শিল্পীর দায় কেবল রূপ নির্মাণে নয়, বরং একটি জাতির স্মৃতি ও চেতনাকে ভবিষ্যতের জন্য ধরে রাখাতেও। সেই দায়িত্ব তিনি পূরণ করেছেন শিল্পের ভাষায়, ইতিহাসের হৃদয়ছোঁয়া আবহে।
হামিদুজ্জামান খান, ভাস্কর হামিদুজ্জামান, সংশপ্তক ভাস্কর্য, বাংলাদেশের শিল্পী, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী, বাংলাদেশে ভাস্কর্য ইতিহাস, জয়নুল আবেদিন, জলরঙ চিত্রকর্ম, হামিদুজ্জামান ফিচার
এই ফিচার প্রতিবেদনটি ‘সমাজকাল’-এ সরাসরি প্রকাশের জন্য প্রস্তুত। চাইলে ছবিসহ ডিজিটাল প্রেজেন্টেশনও তৈরি করে দেওয়া যাবে।