রোজমাওয়াত্তি রেমোর আকাশ ছোঁয়ার গল্প
সমাজকাল
প্রকাশ: ১৩:৪৩, ১২ জুলাই ২০২৫

রোজমাওয়াত্তি রেমোর আকাশ ছোঁয়ার গল্প, ইতিহাস গড়া এক মুসলিম নারী পাইলট
সমাজকাল ডেস্ক
১৯৯৮ সালে যখন রোজমাওয়াত্তি রেমো প্রথমবার ককপিটে বসেন, তখন শুধু নিজের স্বপ্ন পূরণই করেননি—তিনি ইতিহাসও গড়েছিলেন। তিনিই ফিলিপাইনের প্রথম মুসলিম নারী যিনি ফিলিপাইন বিমানবাহিনীতে পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
দক্ষিণ ফিলিপাইনের মুসলিম-প্রধান সুলু প্রদেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা রেমো একটি রক্ষণশীল পরিবারে বড় হন, যেখানে নারীদের ভূমিকা ছিল সীমিত। সেই প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া, ১,০০০ কিলোমিটার দূরে ম্যানিলায় পাড়ি জমানো এবং বিমান চালানোর সিদ্ধান্ত প্রথমদিকে পরিবারের কাছ থেকে সমর্থন পায়নি।
“আমার বাবা তখন একজন স্কুলপ্রধান ছিলেন। তিনি চাইতেন আমি তার পথ অনুসরণ করি,” বলছিলেন কর্নেল রেমো। “ম্যানিলায় রওনা হওয়ার আগের দিন বাবাকে বলেছিলাম আমার ফ্লাইট রয়েছে। তিনি তখন বলেন, ‘তুমি তো তোমার ভাইদের অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছো... আমরা এখনো বেঁচে আছি, আর তুমি ইতিমধ্যেই নিজের সিদ্ধান্ত নিচ্ছো।’”
এই কথাগুলো তাকে নিরুৎসাহিত করেনি, বরং সাহস যুগিয়েছে। “এই কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে, যখনই আমি ভেঙে পড়ি,” বললেন তিনি। “এই কথা আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি হাল ছেড়ে দিতে পারি না।”
১৯৯২ সালে সশস্ত্র বাহিনীর ‘উইমেন’স অক্সিলিয়ারি কর্পস’-এর মাধ্যমে রেমো তার সামরিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরের বছর তিনি অফিসার ক্যান্ডিডেট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৯৪ সালে তিনি যখন স্নাতক হন, তখনই প্রথমবারের মতো একটি আইন কার্যকর হয়, যার ফলে নারীদের জন্য সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও পুলিশে নেতৃত্ব এবং যুদ্ধ-সংক্রান্ত পদে যোগদানের সুযোগ উন্মুক্ত হয়—যা আগে ছিল শুধু পুরুষদের জন্য।
“আমরা তখন স্নাতক হওয়ার কাছাকাছি। লটারির মাধ্যমে বাহিনী নির্ধারণ হচ্ছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমার ভাগ্যে পড়েছিল ফিলিপাইন বিমানবাহিনী,” বললেন রেমো।
চার বছর পর তিনি পাইলট প্রশিক্ষণ শুরু করেন এবং হেলিকপ্টার উদ্ধার অভিযানে বিশেষজ্ঞ হন। ৫০৫তম সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ গ্রুপে নিযুক্ত হয়ে তিনি বেল-২০৫ এবং হিউই হেলিকপ্টার চালান দুর্যোগকালীন উদ্ধার অভিযানে। পাশাপাশি ব্ল্যাক হক ও সিকোরস্কি হেলিকপ্টারেও কো-পাইলট হিসেবে কাজ করেছেন সামরিক পরিবহন ও ত্রাণ কার্যক্রমে।
তিন সন্তানের জননী রেমোর স্বামী বিমানবাহিনীর পাইলট। মা হওয়ার দায়িত্ব ও সামরিক ক্যারিয়ারের ভারসাম্য তিনি দক্ষতার সঙ্গেই রক্ষা করেছেন, কখনো একটিকে অন্যটির পথে বাধা হতে দেননি।
২০০৮ সালের টাইফুন ফ্র্যাঙ্কের পর মধ্য মিন্দানাওয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন তিনি। সেই সময় তার অনুপ্রেরণা ছিল দুইটি: এক, নিঃস্ব মানুষের মুখে আশার ঝিলিক যখন তারা হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনত; আর দুই, তার নিজের সন্তানরা, যারা তাকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় থাকত।
“আমি সবসময় চেষ্টা করতাম, ডিপ্লয়মেন্ট এরিয়ায় ওদের (সন্তানদের) সঙ্গে রাখি। মিশন শেষে নামার পর ওদের মুখ দেখতাম, তখনই মনে হতো—আমাকে বেঁচে ফিরতেই হবে,” বলেন তিনি।
বর্তমানে কর্নেল রেমো ফিলিপাইন বিমানবাহিনীর ৪১০তম মেইনটেনেন্স উইং-এর ডেপুটি উইং কমান্ডার হিসেবে কর্মরত। ২,০০০ ঘণ্টার বেশি সময় তিনি কাটিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ মিশনে—উদ্ধার, ত্রাণ, পুনর্বাসন। ১৯৯৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারাস্যুট প্রদর্শনীতেও অংশ নিয়েছেন।
নিজের এই দীর্ঘ ও কৃতিত্বপূর্ণ ক্যারিয়ারকে রেমো বিশেষ কিছু বলে মনে করেন না।
“আমি সবসময় মাটিতেই পা রাখি,” বলেন তিনি। “আপনার যদি কোনো স্বপ্ন থাকে, তাহলে আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে নিতে হবে।”