প্রাডার 'কলাপুরি' বিতর্ক : ভারতের ঐতিহ্য কি বারবার ব্র্যান্ডের শোষণের শিকার?
সমাজকাল
প্রকাশ: ১৩:০১, ১৯ জুলাই ২০২৫

প্রাডার 'কলাপুরি' বিতর্ক : ভারতের ঐতিহ্য কি বারবার ব্র্যান্ডের শোষণের শিকার?
সমাজকাল ডেস্ক
ইতালীয় বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাডা সম্প্রতি তীব্র বিতর্কের মুখে পড়ে, যখন তাদের মিলান ফ্যাশন শোতে মডেলরা যে চপ্পল পরে হাঁটেন, তা ভারতের ঐতিহ্যবাহী ‘কলাপুরি চপ্পল’-এর নকশার অনুকরণে তৈরি বলে অভিযোগ ওঠে। তবে ব্র্যান্ডটি প্রথমে কোনও স্বীকৃতি না দিলেও সমালোচনার মুখে পড়ে অবশেষে এর উৎস ‘কলাপুর’ শহরকে স্বীকার করে নেয় এবং স্থানীয় কারিগরদের সঙ্গে সংলাপের কথা জানায়।
প্রাডা সম্প্রতি মহারাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্স, ইন্ডাস্ট্রি ও অ্যাগ্রিকালচারের সঙ্গে একটি “সফল বৈঠক” করেছে এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ইঙ্গিত দিয়েছে। যদিও ঠিক কীভাবে তারা সহযোগিতা করবে তা এখনও পরিষ্কার নয়, তবে এই ঘটনা বিশ্ব ফ্যাশন শিল্পে একটি বিরল নজির হয়ে উঠেছে যেখানে কোনও বিলাসবহুল ব্র্যান্ড স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি দায় স্বীকার করেছে।
সংস্কৃতির শোষণ বনাম অনুপ্রেরণা
ভারতের লোকশিল্প ও কারুশিল্প বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের অনুপ্রেরণার উৎস হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসবের যথাযথ স্বীকৃতি বা প্রতিদান দেওয়া হয় না। এই বছরের শুরুতেই রিফরমেশন ও এইচঅ্যান্ডএম-এর পোশাক নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুকরণের অভিযোগ ওঠে, যেখানে দক্ষিণ এশীয় পোশাকের ছাপ স্পষ্ট ছিল। আবার, সম্প্রতি ডিওর প্যারিসে তাদের এক প্রদর্শনীতে উত্তর ভারতের শতাব্দী প্রাচীন ‘মুকাইশ’ কাজকে ব্যবহার করলেও কোথাও ভারতের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেনি।
কেন বারবার ভারতীয় ঐতিহ্য ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকশায় বৈচিত্র্য আনার উদ্দেশ্যে বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন ডিজাইনাররা বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নেন। তবে তা যদি যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতিসহ না হয়, তবে সেটিকে শোষণই বলা যায়।
দিল্লির ফ্যাশন লেখিকা শেফালী বসুদেব বলেন, “ডিজাইন স্কুলেই শেখানো হয় উৎসকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। যেসব ব্র্যান্ড ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসার কথা বলে, তারাই যদি এই ন্যূনতম দায়ও না নেয়, সেটি সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।”
ভারতের বিলাসবহুল বাজার: অবহেলার কারণ?
বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের তথ্যমতে, ২০৩২ সালের মধ্যে ভারতের বিলাসবহুল বাজার ১৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। তবে প্রযুক্তি পরামর্শক সংস্থা টেকনোপাকের চেয়ারম্যান অরবিন্দ সিংহল বলছেন, “ভারতে বিলাসবহুল ফ্যাশনের প্রকৃত ক্রেতা এখনো সীমিত। তাই অনেক ব্র্যান্ডই এই বাজারকে গুরুত্ব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়।”
নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষায় ভারত কতটা প্রস্তুত?
ফ্যাশন ডিজাইনার আনন্দ ভূষণ মনে করেন, “ভারত বরাবরই ফ্যাশনের ‘প্রোডাকশন হাব’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কেউ আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কারিগরদের পরিশ্রমকে উপেক্ষা করে মুনাফা লুটবে।”
দাস্তকারের চেয়ারপার্সন লায়লা ত্যাবজির মতে, “আমরা আমাদের নিজস্ব হস্তশিল্পের যথাযথ মূল্য না দিয়ে বাইরের পণ্যে অযৌক্তিক খরচ করি। ফলে আন্তর্জাতিক ডিজাইনাররাও আমাদের ঐতিহ্যকে অবমূল্যায়ন করেই চলবে।”
সমাধান কী?
টাটা ক্লিক বিলাসবহুল পোর্টালের প্রধান সম্পাদক ননিতা কালরা মনে করেন, “প্রাডার এই ভুল অনিচ্ছাকৃত হলেও, তাদের ভুল শুধরে নেওয়ার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়।” তবে তিনি এটাও বলেন, “বিশ্ব ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বৈচিত্র্যের অভাব বড় বাধা। শুধুমাত্র পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত ব্র্যান্ডগুলি বিশ্বের অন্য প্রান্তের সংস্কৃতিকে অনেক সময় সঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়।”
এই বিতর্ক শুধুমাত্র প্রাডা নয়, বরং একটি বৃহত্তর বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি ফেরায়—ভারতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বারবার বৈশ্বিক স্বীকৃতির অভাবে শোষণের শিকার হয়। এই প্রেক্ষাপটে এখন সময় এসেছে নিজেদের শিল্প ও শিল্পীদের উপযুক্ত সম্মান, সুরক্ষা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার।
যতদিন না ভারত নিজে নিজের ঐতিহ্যের গৌরব রক্ষা করতে শেখে, ততদিন অন্যরা সেই ঐতিহ্য নিয়েই নিজেদের লাভের হিসেব কষে যাবে। সময় এসেছে নিজেদের সংস্কৃতিকে সম্মান করার — শুধু বিদেশি ব্র্যান্ডকে দায়ী করলেই চলবে না, নিজেদের ভেতরও আত্মসমালোচনা জরুরি।