বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫

| ১২ ভাদ্র ১৪৩২

ইসরায়েল ত্রাণ কেন্দ্রে প্রায় ৬০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে

সমাজকাল

প্রকাশ: ২২:১৩, ২৯ জুন ২০২৫

ইসরায়েল ত্রাণ কেন্দ্রে প্রায় ৬০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে

ইসরায়েল পরিচালিত গাজার যুদ্ধে গভীর হয়েছে দুর্ভিক্ষ। গাজায় খাদ্য সহায়তা দিতে ইসরায়েলের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচ‌এফ) কার্যক্রম শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, এই ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে খাদ্য সহায়তা নিতে আসা অন্তত ৫৮৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। অনাহারে ও অপুষ্টিতে ভুগছে লক্ষাধিক মানুষ। গাজার এই ত্রাণকেন্দ্রগুলোকে মৃত্যুকূপ বলে অভিহিত করছে আন্তির্জাতিক গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থা।

সমাজকাল ডেস্ক

গাজায় দুর্ভিক্ষ আরও গভীর হওয়ায় খাদ্য সহায়তার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে নিহত শত শত মানুষ, লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে ও অপুষ্টিতে ভুগছে।

গত ২৭ মে থেকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচ‌এফ) পরিচালিত সহায়তা কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় অন্তত ৫৮৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৪,১৮৬ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজা উপত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এই মৃত্যুর ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে, যখন গোটা উপত্যকা দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বহু সপ্তাহ ধরে সতর্ক করে আসছে যে, গাজার ২১ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য মজুদ ফুরিয়ে গেছে, পরিষ্কার পানির সংকট রয়েছে এবং সহায়তা সরবরাহ অপ্রতুল ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

জিএইচ‌এফ এর কার্যক্রম শুরুর প্রথম আট দিনেই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।আল জাজিরার হানি মাহমুদ গাজা সিটি থেকে জানান, “জিএইচ‌এফ বর্তমানে গাজার একমাত্র খাদ্য সরবরাহকারী উৎস, কারণ ইসরায়েল অন্যান্য সংস্থার জন্য ত্রাণ সরবরাহে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বহু মানুষ এখন এসব কেন্দ্রে যেতে ভয় পাচ্ছে, কারণ সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে সহায়তা প্রত্যাশীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হচ্ছে। কিন্তু তবুও না যাওয়ার উপায় নেই, কারণ খাদ্যের প্যাকেট না পেলে শিশুরা না খেয়ে ঘুমাতে যেতে বাধ্য হবে।”

 

সহায়তা কেন্দ্রগুলো কোথায়?

আগে জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন সহায়তা নেটওয়ার্ক গাজা জুড়ে প্রায় ৪০০টি বিতরণকেন্দ্র পরিচালনা করত। কিন্তু জিএইচ‌এফ মাত্র চারটি ‘মেগা-সাইট’ চালু করেছে—দক্ষিণে তিনটি ও মধ্য গাজায় একটি। উত্তরে কোনো কেন্দ্র নেই, যদিও সেখানকার পরিস্থিতিই সবচেয়ে ভয়াবহ। 

জিএইচ‌এফ কেন্দ্রগুলো অনিয়মিতভাবে খোলা থাকে, কখনো কখনো মাত্র এক ঘণ্টার জন্য। একবার একটি কেন্দ্র ফেসবুকে খোলার ঘোষণা দেয়, কিন্তু মাত্র ৮ মিনিট পরেই জানিয়ে দেয় যে, সহায়তা শেষ। এই কেন্দ্রগুলো প্রথমে আসা প্রথমে পাওয়া ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, ফলে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং মানুষজনের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।

মানুষ কীভাবে এসব কেন্দ্রে যায়?

এই কেন্দ্রগুলোতে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। ফিলিস্তিনিদের অনেক সময় সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র অতিক্রম করতে হয়, জৈব-পরিচয় যাচাইকরণ চেকপয়েন্ট পেরিয়ে যেতে হয় এবং পরিবারগুলোর জন্য ভারী খাদ্য সামগ্রী বহন করে আনতে হয়। ফলে, যারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন—যেমন বৃদ্ধ, আহত ও প্রতিবন্ধীরা—তারা এই সহায়তা পাওয়ার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন।

বক্সে কী থাকে?

এই সহায়তা প্যাকেটগুলো মানুষের ন্যূনতম জীবিকার চাহিদাও পূরণ করতে পারে না। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি যেখানে প্রতিদিন ২,১০০ ক্যালোরি সুপারিশ করে, সেখানে ইসরায়েল তা কমিয়ে ১,৬০০ ক্যালোরিতে সীমিত করেছে।

জিএইচ‌এফ এর প্যাকেট একটু বেশি—প্রায় ১,৭৫০ ক্যালোরি—তবে তা এখনো পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে না। প্যাকেটে থাকে না কোন পরিষ্কার পানি, ওষুধ, কম্বল বা জ্বালানি। এভাবে সহায়তা পাওয়া অনেকের জন্য উপশম নয়, বরং একটি দুঃসাধ্য ভাগ্য।

আল জাজিরার হিন্দ আল-খৌদারির রিপোর্ট অনুযায়ী, একটি জিএইচ‌এফ বক্সে থাকে ৪ কেজি আটা, কিছু পাস্তা, দুটি ফাভা বিনসের ক্যান, একটি চায়ের প্যাকেট ও কিছু বিস্কুট। কখনো কখনো এতে কিছু ডাল ও স্যুপ মিশ্রণও থাকে, তবে পরিমাণ খুব কম।

মানুষ কি ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে?

ইসরায়েলি পত্রিকা হারেতজ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েলি সেনারা স্বীকার করেছে যে, তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপরও গুলি চালাতে।

একজন সৈন্য বলেন, “আমরা ট্যাঙ্ক থেকে মেশিনগান দিয়ে গুলি করেছি এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছি। একবার একটি দল কুয়াশার আড়ালে এগিয়ে আসছিল, তখন তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।”

অন্য এক সৈন্য জানান, “আমার দায়িত্বকালে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে পাঁচজন পর্যন্ত মানুষ নিহত হয়েছে। এটা একটা হত্যার মাঠ।”

জিএইচ‌এফ কী?

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর আগে গাজায় প্রতিদিন প্রায় ৫০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করত। যুদ্ধ শুরুর পর এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় দিনে ৮০টির নিচে, আর মার্চে ইসরায়েল সবধরনের সহায়তা বন্ধ করে দেয় তিন মাসের জন্য। 

২৭ মে জিএইচ‌এফ দায়িত্ব নেয় এবং জাতিসংঘের বাইরে একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করে। জিএইচ‌এফ  প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৫ সালে এবং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস একে "ইসরায়েলি মস্তিষ্কপ্রসূত একটি প্রকল্প" হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা গাজার ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ।

জিএইচ‌এফ এখনো তার অর্থায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। তারা বলছে ১০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তবে বিস্তারিত অজানা। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর সম্প্রতি ৩০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান দিয়েছে।

গাজার শিশুদের কী অবস্থা? 

ইউনিসেফ সতর্ক করেছে—গাজায় শিশুপুষ্টিহীনতা “অত্যন্ত উদ্বেগজনক হারে” বাড়ছে। শুধু মে মাসেই, ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত ৫,১১৯ শিশুকে তীব্র অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে—এপ্রিলের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারির তুলনায় ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি, যেদিন একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতির কারণে কিছু ত্রাণ প্রবেশ করেছিল।

ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের পরিচালক এদুয়ার্দ বেইগবেদার বলেন, “শুধু জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ১৫০ দিনে ১৬,৭৩৬ শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে—প্রতিদিন গড়ে ১১২ জন। এদের প্রতিটিই প্রতিরোধযোগ্য। তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি ও পুষ্টি চিকিৎসা তাদের কাছে পৌঁছাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এটি মানবসৃষ্ট সংকট, যা শিশুদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে।”

ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্তত ১৯টি ক্ষেত্রে সহায়তা বিতরণের সময় শিশুদের মৃত্যু ঘটেছে।

ইসরায়েল কীভাবে গাজাবাসীকে ক্ষুধার মাধ্যমে শাস্তি দিচ্ছে?

গাজা উপত্যকার প্রতি পাঁচজনের একজন এখন সরাসরি দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। সহায়তা কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা এই ক্ষুধার ভয়াবহতা স্পষ্ট করে। সর্বশেষ আইপিসি (Integrated Food Security Phase Classification) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার ১.৯৫ মিলিয়ন মানুষ—অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ—তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। 

বিশেষ করে উত্তর গাজায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আইপিসি জানিয়েছে, ইসরায়েলের অব্যাহত অবরোধের ফলে মানুষ আরও ব্যাপকভাবে বাস্তুচ্যুত হবে এবং তাদের টিকে থাকার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ফুরিয়ে যাবে।

অনুবাদ: সমাজকাল ডেস্ক

আলজাজিরা থেকে

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ: