আলোচিত আলী খামেনির জীবনালেখ্য
সমাজকাল
প্রকাশ: ১৩:৫০, ২৮ জুন ২০২৫

আলোচিত আলী খামেনির জীবনালেখ্য, গত ১৩ জুন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা জাগানো ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ১২ দিনে শেষ হয়েছে। এবারের মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সব কিছুকে ছাপিয়ে এই আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন ইসরায়েলের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড থাকা ইরানের লৌহমানব খ্যাত রহস্য পুরুষ আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
মাইসারা জান্নাত
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্লোগানে শুরু হওয়া ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ১২ দিনে শেষ হয়েছে। ড্রোন ও মিসাইল ছোড়া বন্ধ হলেও কথা ছোড়াছুড়ি প্রতিনিয়ত হচ্ছে। একে অপরকে উত্তপ্ত বাক্যবাণে জর্জরিত করছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে আলোচনা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে নিয়ে। যিনি ইসরায়েলের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড। আলী খামেনিকে হত্যার হেন কোনো চেষ্টা নেই যে ইসরায়েল করেনি। কিন্তু হত্যা করার মতো কার্যকর কোনো মাধ্যম পায়নি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ অকপটে স্বীকার করেছেন বিষয়টি।
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। ইরানের প্রেসিডেন্ট ও সংসদ সদস্যরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও প্রকৃত ক্ষমতা থাকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার হাতে। ১৯৮৯ সাল থেকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং একটি ধর্মীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে রেজা শাহ পাহলভির শাসনের অবসান হয় এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থা চালু হয়। এরপর থেকে দেশটি পেয়েছে দুজন সর্বোচ্চ নেতা, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনি ও আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি আধুনিক যুগের একজন শিয়া প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ ও আলেম। তার জীবন একাধারে ত্যাগ, সংগ্রাম, জ্ঞানচর্চা ও নেতৃত্বগুণে পরিপূর্ণ। শৈশব থেকে শুরু করে পরিণত বয়স পর্যন্ত তার জীবনধারা ছিল শিয়া ধর্মীয় অনুশাসন ও রাজনৈতিক চেতনায় গঠিত।
শৈশব-কৈশোর
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৭ জুলাই ইরানের বিখ্যাত নগরী মাশহাদে। তিনি দরিদ্র ও ধার্মিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা আয়াতুল্লাহ সায়্যেদ জওয়াদ হোসেইনি খামেনি আলেম ছিলেন। পিতামহও ছিলেন ধর্মীয় মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। মা মিরদমাদি ছিলেন একজন সংস্কৃতিপ্রেমী ও ধার্মিক নারী, যিনি নিজের সন্তানদের কোরআন শিক্ষা ও নৈতিকতা দিয়ে গড়ে তোলেন। আলী খামেনি এক ফার্সি দৈনিকের সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের ঘরে দারিদ্র্য ছিল, কিন্তু আত্মিক সমৃদ্ধি ছিল তার চেয়েও বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার পিতা ছিলেন একজন পরিচিত আলেম, অত্যন্ত পরহেজগার ও নিভৃতচারী। আমাদের জীবন ছিল কষ্টের, এমন রাতও ছিল যখন আমাদের ঘরে রাতের খাবারই থাকত না! মা কষ্ট করে আমাদের জন্য নান ও কিশমিশ প্রস্তুত করতেন।’
আলী খামেনি শৈশবে দরিদ্র, ধর্মভীরু এবং আন্তরিক পরিবেশে গড়ে ওঠেন। শৈশবেই তিনি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। চার বছর বয়সে কোরআন শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দারুত তালিম দাইয়ানি নামক এক ধর্মীয় স্কুলে। শৈশবে তিনি কোরআন মুখস্থ, আহলুল বায়তের প্রতি ভালোবাসা, নামাজ ও শিষ্টাচার আত্মস্থ করেন। আলী খামেনির শৈশব ছিল নিষ্ঠা, ধৈর্য ও পরিশ্রমে গড়া।
কোরআন ও আরবি সাহিত্যে তার আগ্রহ ছিল গভীর। কোরআনের গভীর অর্থ অনুধাবনে তার অসাধারণ মনোযোগ ও ধীশক্তি তাকে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা করেছিল। তিনি বিভিন্ন সময় মাশহাদ, কোম ও নাজাফের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। তার ওস্তাদদের মধ্যে ছিলেন আয়াতুল্লাহ বোর্জার্দি, আয়াতুল্লাহ হাশেমি কুযওয়িনি, আয়াতুল্লাহ মিলানি এবং ইমাম রুহুল্লাহ খামেনি।
রাজনৈতিক উত্থান
১৯৬২ সালে তিনি রুহুল্লাহ খামেনির আন্দোলনে যোগ দেন এবং শাহবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে একাধিকবার গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর তিনি বিপ্লবী পরিষদের সদস্য হন এবং পরবর্তীতে উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর গঠনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৮১ সালে একটি মসজিদে বোমা হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন এবং তার ডান হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। ওই বছরের জুনে প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ আলী রাজাই নিহত হলে খামেনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী আট বছর এ দায়িত্বে থাকেন।
সর্বোচ্চ নেতার আসনে অধিষ্ঠিত
১৯৮৯ সালে রুহুল্লাহ খামেনির মৃত্যুর পর বিশেষজ্ঞ পরিষদ আলী খামেনিকে সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত করে। যদিও তিনি তখন ‘গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ’ ছিলেন না, সংবিধান সংশোধন করে তাকে উপযুক্ত ঘোষণা করা হয়। রাতারাতি তাকে হুজ্জাতুল ইসলাম থেকে আয়াতুল্লাহ পদে উন্নীত করা হয়। তখনই সংবিধানে আরও একটি বড় পরিবর্তন আসে, প্রধানমন্ত্রী পদের বিলুপ্তি এবং রাষ্ট্রপতির হাতে অধিক ক্ষমতা প্রদান। তবে বাস্তবে দেশটির সব বড় সিদ্ধান্তের শেষ কথাটি বলেন সর্বোচ্চ নেতা।
রাষ্ট্রপতিদের সঙ্গে সম্পর্ক
খামেনির শাসনকালে ছয়জন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করেছেন, যাদের মধ্যে আছেন মুহাম্মদ খাতামি, মাহমুদ আহমাদি নেজাদ, হাসান রুহানি, ইব্রাহিম রাইসি ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। মুহাম্মদ খাতামি সংস্কারপন্থি হওয়ায় তার অনেক উদ্যোগে খামেনি বাধা দিয়েছেন। আহমাদি নেজাদের সঙ্গে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে জড়ান তিনি।
সংকট ও চ্যালেঞ্জ
২০০৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচন এবং গণবিক্ষোভ দমন ছিল তার শাসনামলের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। এরপর ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় কাসেম সোলেইমানি নিহত হন। সোলেইমানি ছিলেন খামেনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বন্ধু। প্রতিশোধ হিসেবে ইরান দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ভুলবশত একটি ইউক্রেনীয় যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে, যাতে ১৭৬ জন নিহত হন। এরপর দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে করোনা মহামারির সূচনা হলেও প্রথমে খামেনি একে গুরুত্ব দেননি।
আন্তর্জাতিক অবস্থান
খামেনি বহুবার ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছেন। ২০১৮ সালে তিনি ইসরায়েলকে ‘একটি ক্যানসার আক্রান্ত টিউমার’ বলেন এবং হলোকাস্ট নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি তার সম্মতিতেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে ‘অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস’ নামের একটি ৮৮ সদস্যবিশিষ্ট ধর্মীয় পরিষদ। এদের নির্বাচন হয় আট বছর অন্তর। তবে সদস্যদের প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দিতে হয় গার্ডিয়ান কাউন্সিলকে, যার সদস্যদের নির্বাচন করেন খামেনি। ফলে এই দুই পরিষদের ওপরই তার প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত। একবার নির্বাচিত হলে সর্বোচ্চ নেতা আজীবন এই পদে বহাল থাকতে পারেন।
উত্তরসূরি নিয়ে প্রশ্ন
৮৬ বছর বয়সী খামেনি বেশ কিছু বছর ধরে স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছেন। তার মৃত্যুর পর কে হবেন উত্তরসূরি, তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে। ইব্রাহিম রাইসিকেই পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, কিন্তু ২০২৪ সালের ১৯ মে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। এর ফলে উত্তরসূরি নির্ধারণ আরও জটিল হয়ে পড়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিক সংঘাতে খামেনির জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় সম্ভাব্য তিনজন উত্তরসূরির নাম আলোচনায় এসেছে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
আলী খামেনি বরাবরই বিশ্বাস করতেন, শুধু রাজনৈতিক শ্লোগানে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, প্রয়োজন মানুষের অন্তর জাগানো, চেতনা জাগ্রত করা এবং কোরআনভিত্তিক শিক্ষা বিস্তার করা। তাই তিনি রাজনৈতিক বক্তব্যের চেয়ে আদর্শ সমাজ গঠন, তরুণদের প্রশ্নের জবাব ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। মূলত তার এই গভীর দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তীকালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে।