বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫

| ১২ ভাদ্র ১৪৩২

আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক যে মুসলিম বিজ্ঞানী

সমাজকাল ডেস্ক 

প্রকাশ: ১২:০১, ২০ আগস্ট ২০২৫

আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক যে মুসলিম বিজ্ঞানী

আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক ইবনে আল-হাইসাম। তার পুরো নাম আবু আলি আল-হাসান ইবনে আল-হাইসাম। তিনি ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণ করেন। মুসলিম বিজ্ঞানীদের স্বর্ণযুগে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান আলোকবর্তিকা, যিনি শুধু আলোকবিজ্ঞান নয়, বরং পদার্থবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শনের বিভিন্ন শাখায় যুগান্তকারী অবদান রেখে গেছেন। পশ্চিমা জগতে তাকে বিকৃত করে ‘আলহাজেন’ নামে পরিচিত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা এবং আলোকবিজ্ঞানের জনক।

তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মিসরের বাদশাহ হাকিমের সঙ্গে যুক্ত। বাদশাহ হাকিম নীল নদের বার্ষিক বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং ইবনে আল-হাইসামকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি বের করতে নির্দেশ দেন। তিনি বসরা থেকে কায়রোয় এসে একটি বিশাল প্রকল্প প্রস্তাব করেন যে, পুকুর ও খালের মাধ্যমে নীল নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু কাজ শুরু করার পর তিনি উপলব্ধি করেন, তৎকালীন প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শাসকের কাছে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করা মানেই ছিল মৃত্যুদণ্ড। তাই নিজের জীবন বাঁচাতে তিনি পাগলের ভান ধরেন। এ কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়।

এই কারাবাস তার জীবনে অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদে পরিণত হয়েছিল। প্রায় দশ বছর কারাগারে কাটানোর সময় তিনি গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ পান। এখানেই তিনি বহু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও সূত্র উদ্ভাবন করেন। কারাবন্দি অবস্থায়ই তিনি রচনা করেন জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব আল-মনাজির’ বা ‘বুক অব অপটিক্স’, যা পরবর্তীকালে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের হাতে পৌঁছায়। এই গ্রন্থই তাকে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়।

আলোকবিজ্ঞানের ইতিহাসে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, ইউক্লিড ও টলেমির ‘নির্গমন তত্ত্ব’ প্রচলিত ছিল। তাদের মতে, মানুষের চোখ থেকে আলোকরশ্মি নির্গত হয়ে বস্তুকে দৃশ্যমান করে। ইবনে আল-হাইসাম এই তত্ত্বকে পরীক্ষার মাধ্যমে ভুল প্রমাণ করেন। তিনি বলেন, দৃষ্টি সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত। আলো বাইরের বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে চোখে প্রবেশ করে এবং তাতে আমরা বস্তু দেখি। এ তত্ত্বই আধুনিক দৃষ্টিবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি।

তার পরীক্ষণধর্মী গবেষণা পদ্ধতি ছিল যুগান্তকারী। তিনি গাণিতিক সূত্র ও পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম ব্যবহার করে আলোর প্রতিসরণ, প্রতিফলন, ছায়া, রঙধনু, চন্দ্রগ্রহণ এবং আলোর বিচ্ছুরণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি প্রমাণ করেন আলো বিভিন্ন মাধ্যমে গতি পরিবর্তন করে এবং বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা নির্ধারণে গবেষণা চালিয়ে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উচ্চতার হিসাব দেন, যা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পরিমাপের সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ইবনে আল-হাইসামের আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হলো পিনহোল ক্যামেরা বা ক্যামেরা অবস্কিউরা। তিনি ছোট একটি ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করা আলোর সাহায্যে বাইরের দৃশ্য কিভাবে উল্টানো অবস্থায় দেয়ালে প্রতিফলিত হয় তা প্রমাণ করেন। এই পরীক্ষাই আধুনিক ফটোগ্রাফি ও ক্যামেরা প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে।

আলোকবিজ্ঞানে তার গবেষণা শুধু দৃষ্টি ব্যাখ্যা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি আলোর প্রতিসরণ সূত্র আবিষ্কার করেন এবং আলোর বিভিন্ন রঙে বিভক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। রঙধনুর সৃষ্টি, ছায়ার প্রকৃতি, আলো বায়ুমণ্ডলে প্রতিসরিত হওয়ার ফলে চন্দ্রগ্রহণের ধরণ, এসব বিষয়ে তার কাজ আজও বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।

পশ্চিমা বিশ্বে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অগ্রদূত হিসেবে যাদের নাম উচ্চারিত হয় যেমন কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, কেপলার ও নিউটন, তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে ইবনে আল-হাইসামের গবেষণা দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষ করে নিউটনের প্রিজমের মাধ্যমে আলোর রঙ বিভাজন সংক্রান্ত গবেষণা ইবনে আল-হাইসামের আবিষ্কারকে ভিত্তি করেই হয়েছিল। অথচ পাঠ্যপুস্তকে তাকে প্রায় উপেক্ষা করা হয়েছে।

একটি বড় মিথ দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমা ইতিহাসচর্চায় প্রচলিত ছিল যে, রোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে শুরু করে ইউরোপের রেনেসাঁর আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে বিজ্ঞানের কোনো অগ্রগতি হয়নি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ইউরোপের অন্ধকার যুগে আরব-মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানচর্চার সোনালি যুগ চলছিল। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গণিত, চিকিৎসা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও দর্শনের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ উন্নতি হয়েছিল। ইবনে আল-হাইসাম ছিলেন সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।

ইবনে আল-হাইসামের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তিনি বিজ্ঞানচর্চায় পরীক্ষামূলক ও পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। তিনি কেবল ধারণা বা দর্শনের ওপর নির্ভর করেননি, বরং বাস্তব পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি তত্ত্বকে যাচাই-বাছাই করেছেন। এজন্য তাকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার জনকও বলা হয়ে থাকে।

তার রচিত ‘বুক অব অপটিক্স’ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে মধ্যযুগীয় ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে এই গ্রন্থ ইউরোপের আলোকবিদ্যা অধ্যয়নের মূল ভিত্তি ছিল।

আজকের দিনে আলোকবিজ্ঞান যেমন লেজার প্রযুক্তি, অপটিক্যাল ফাইবার, ফটোগ্রাফি, টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ ও চিকিৎসা সরঞ্জামে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, তার শেকড় নিহিত আছে ইবনে আল-হাইসামের গবেষণায়।

আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক হিসেবে ইবনে আল-হাইসামের নাম অবিসংবাদিত। তার গবেষণা শুধু আলোকবিদ্যার ক্ষেত্রেই নয়, বরং সমগ্র বিজ্ঞানের ইতিহাসে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, আলোকে বুঝতে হলে তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেই পরীক্ষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গিই আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তি। তবুও দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা ইতিহাসে অনেক সময় তার নাম বিকৃত করা হয়েছে বা আড়ালে রাখা হয়েছে। কিন্তু সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না। বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে যে, ইবনে আল-হাইসামই ছিলেন আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার অগ্রদূত।

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ: