আশুরা নিয়ে শিয়া-সুন্নির দৃষ্টিভঙ্গি
প্রকাশ: ০৭:৪২, ৬ জুলাই ২০২৫
আশুরা নিয়ে শিয়া-সুন্নির দৃষ্টিভঙ্গি ।এই পার্থক্য শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় নয়, বরং তা আবেগ, ধর্মচিন্তা, ইতিহাসের ব্যাখ্যা এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধির স্তরেও প্রভাব ফেলে। আশুরা নিয়ে শিয়া ও সুন্নিদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
সমাজকাল ডেস্ক
ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। এই মাসের দশম দিনকে বলা হয় আশুরা, যা স্মরণ, শোক, শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির এক অনন্য দিন। তবে আশুরাকে ঘিরে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য। এই পার্থক্য শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় নয়, বরং তা আবেগ, ধর্মচিন্তা, ইতিহাসের ব্যাখ্যা এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধির স্তরেও প্রভাব ফেলে। আশুরা নিয়ে শিয়া ও সুন্নিদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব : মহররমের ১০ তারিখে সংঘটিত হয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা। হাদিসে এসেছে, এই দিনে হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি পান। নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পর্বতে স্থির হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আগুন থেকে রক্ষা পান। হজরত ইয়াকুব (আ.) পুত্র ইউসুফকে ফিরে পান। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে জানতে পারেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখে মুসা (আ.)-এর মুক্তির স্মরণে। তিনি বলেন, ‘আমরা মুসা (আ.)-এর প্রতি ইহুদিদের চেয়ে বেশি হকদার।’ তিনিও আশুরার রোজা রাখেন এবং সকলকে রাখতে উৎসাহ দেন। (সহিহ মুসলিম)
তবে ইসলামের ইতিহাসে আশুরার সবচেয়ে বেদনাবিধুর ঘটনা হলো কারবালার ট্র্যাজেডি, যেখানে হিজরি ৬১ সালে মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার ও সাথীদের নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শহীদ হন। এই ঘটনার কারণেই আশুরা শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্ন অর্থবোধে উপস্থাপিত হয়।
সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গি : সুন্নি মুসলমানদের দৃষ্টিতে আশুরা ইবাদত ও কৃতজ্ঞতার দিন। রোজা রাখা, দান-সদকা এবং আত্মশুদ্ধির জন্য বিভিন্ন নফল ইবাদত করাই এই দিনের মূল অনুষঙ্গ। তারা আশুরার দিনে হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতকে স্মরণ করেন, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান, তবে মিছিলের মাধ্যমে নয়, বরং দোয়ার মাধ্যমে।
তাদের দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামের সত্য আদর্শ রক্ষায় শহীদ হয়েছেন, তার পথ অনুসরণ করাই শ্রেষ্ঠতা। তবে এ দিনকে অতিমাত্রায় শোকের দিনে পরিণত করা কিংবা আত্ম-নির্যাতনের আচারকে তারা ইসলামবিরোধী মনে করেন।
হাদিসভিত্তিক শিক্ষা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়। (সহিহ মুসলিম) এই হাদিস সুন্নি মতবাদে আশুরাকে আত্মশুদ্ধির দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি : শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে আশুরা শোক ও প্রতিবাদের এক মহাদিবস। তাদের দৃষ্টিতে কারবালার ঘটনা কেবল রাজনৈতিক সংঘর্ষ নয়, বরং তা ছিল হক ও বাতিলের মধ্যে এক চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব, যেখানে সত্যের প্রতীক ছিলেন হোসাইন (রা.), আর বাতিলের মুখপাত্র ছিল ইয়াজিদি শাসনব্যবস্থা।
শিয়ারা এই দিনে কালো পোশাক পরিধান করেন, শোকের মজলিস করেন, মাটিতে বসে হোসাইন (রা.) ও তার সাথীদের মর্মান্তিক মৃত্যু স্মরণ করেন। অনেকে মাতম বা বুকে আঘাত করে কান্না করেন। কোনো অঞ্চলে প্রতীকী কবর বা মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে কারবালার ঘটনার অভিনয়ও করা হয়। ইরাকের কারবালায় প্রতি বছর আশুরার দিন মিলিত হন লাখো শিয়া অনুসারী।
শিয়াদের মতে, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত শুধু অতীত ইতিহাস নয়, বরং এটি একটি চিরন্তন বিপ্লব, যা জালেম শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অনন্ত চেতনা।
ভিন্নতা ও বিভেদ : দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আশুরাকে ঘিরে এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা বহু সময় বিভেদ ও বিরোধে পরিণত হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও মতবাদের দ্বন্দ্ব আশুরার দৃষ্টিভঙ্গিকে অনেক সময় বিতর্কিত করেছে। তবে উভয় পক্ষই হোসাইন (রা.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল এবং তার আত্মত্যাগকে গুরুত্ব দেয়।