বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫

| ১২ ভাদ্র ১৪৩২

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা

সমাজকাল

প্রকাশ: ০৭:৩৪, ৬ জুলাই ২০২৫

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা ৬১ হিজরির ১০ মহররম (আশুরার দিন) কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত হয় । যেখানে হজরত হোসাইন (রা.) ও তার পরিবার-পরিজনসহ প্রায় ৭২ জন শাহাদাত বরণ করেন।

মাইসারা জান্নাত

ইতিহাসের কিছু কিছু ঘটনা যুগযুগান্তর ধরে মানুষের হৃদয়ে রেখাপাত করে, চেতনাকে নাড়া দেয়, মূল্যবোধকে শাণিত করে এবং সাহস-আত্মত্যাগের উদাহরণ হয়ে জাগিয়ে তোলে অনুপ্রেরণার অগ্নিশিখা। তেমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত। এ ঘটনা শুধু একটি যুদ্ধ বা সংঘর্ষ নয়, বরং এটি ছিল এক গভীর নৈতিক, ধর্মীয় ও আদর্শিক সংগ্রামের উজ্জ্বল দলিল।

কারবালার ঘটনা এমন এক সময় সংঘটিত হয়েছিল, যখন ইসলামি খেলাফতের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল, সত্য ও ন্যায়ের মানদণ্ডে নেতৃত্ব যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে উঠেছিল। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) ঠিক সেই মুহূর্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সত্য, ন্যায় এবং ইসলামি আদর্শের পক্ষে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।

তাই কারবালা কোনো শোকাবহ দিনের স্মৃতি নয়, বরং এটি একটি চেতনার নাম, যেখানে অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করে সত্যের পতাকা হাতে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার আছে। হজরত হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা শিখি, অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, তার সামনে আপোষ নয়, বরং প্রতিরোধই হলো প্রকৃত মুসলিমের পরিচয়। এখানে কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণী তুলে ধরা হলো।

কারবালা ইরাকের বাগদাদ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি ময়দানের নাম। ৬১ হিজরির ১০ মহররম আশুরার দিন ফোরাত নদীর তীরে সংঘটিত হয় ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হজরত হোসাইন (রা.) ও তার পরিবার-পরিজনসহ প্রায় ৭২ জন শাহাদাত বরণ করেন। তার একমাত্র জীবিত পুত্র হজরত জয়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া কেউই সেদিন বাঁচতে পারেনি।

এই কারবালার যুদ্ধ কোনো আকস্মিক সংঘর্ষ নয়, বরং এটি ছিল একটি গভীর রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আদর্শিক দ্বন্দ্বের ফল। কারবালা যুদ্ধের অন্যতম কারণ হলো ইয়াজিদের অবৈধ মনোনয়ন। জলিলে কদর সাহাবি আমিরে মুয়াবিয়া (রা.) নিজের পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকার ঘোষণা করলে অনেক সাহাবি ও তাবেয়ি এর বিরোধিতা করেন। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। ইয়াজিদের চরিত্র, জীবনাচার ও শাসননীতি ইসলামের মৌলিক নীতিমালার পরিপন্থি হওয়ায় ইমাম হোসাইন (রা.) তার প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন এবং খেলাফতের ন্যায়পরায়ণতা রক্ষায় তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। (তারিখে তাবারি)

ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, উমাইয়া শাসনের অধীনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছিল। তখন ইমাম হোসাইন (রা.) খেলাফতের পুনর্জীবন এবং নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের লক্ষ্যে মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা করেন। এর পেছনে ছিল কুফাবাসীর আহ্বান। কারবালার ঘটনার পেছনে অন্যতম কারণ হলো কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা। কুফাবাসীরা ইয়াজিদের শাসনের বিরুদ্ধে হজরত হোসাইন (রা.)-কে নেতা হিসেবে আহ্বান জানায়। তবে পরে তারা ভীত হয়ে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। পথিমধ্যে ইয়াজিদ হোসাইন (রা.)-কে আটকে ফেলার নির্দেশ দেয়। কারবালা নামক স্থানে হোসাইন (রা.)-এর বাহিনীকে অবরোধ করা হয়। তখন হোসাইন (রা.) ইয়াজিদ বাহিনীকে তিনিটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এক. তাকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক। দুই. সীমান্তে গিয়ে জীবনযাপন করতে দেওয়া হোক। তিন. এ দুটোর একটিও না হলে ইয়াজিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সুযোগ দেওয়া হোক। কিন্তু নিষ্ঠুর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান থেকে এক চুল সরে আসেনি।

ঐতিহাসিকরা লেখেন, ১০ মহররম ফজরের নামাজের পর ইয়াজিদের চার হাজার সৈন্য হোসাইন (রা.) ও তার পরিবারকে পানি সরবরাহ বন্ধ রেখে ঘিরে ফেলে। এ দিন দুপুর পর্যন্ত এক অসম যুদ্ধ চলে। হোসাইন (রা.) একে একে তার পরিবার ও সহচরদের শাহাদাত প্রত্যক্ষ করেন। শেষে তিনি নিজেও শাহাদাত বরণ করেন।

তার শাহাদাত এতটাই নির্মম ছিল যে, শরীরে ৩৩টি বর্শা, ৩৪টি তরবারির আঘাত এবং অসংখ্য তীরের ক্ষত চিহ্ন পাওয়া যায়। হত্যাকারী ছিল সিনান ইবনে আনাস নাখায়ি এবং সহযোগী হিসেবে ছিল খাওলি ইবনে ইয়াজিদ। তার মস্তক কেটে দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে পাঠানো হয়। (কারবালার ইতিহাস, আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী)

হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ইয়াজিদের জন্য এক ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে। ইয়াজিদ ছিল ইসলামি ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত শাসকদের একজন। তার তিন বছরের শাসনামলে তিনটি ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়। এক. হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত। দুই. মদিনায় লুট ও ধর্ষণ এবং মসজিদে নববীর অবমাননা। তিন. মক্কায় আক্রমণ, কাবার অবমাননা। এই অপরাধগুলোর কারণে ইসলামি ইতিহাসে ইয়াজিদের মৃত্যু রহস্যজনকভাবে ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ বলেন, বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে, কেউ বলেন পানির পিপাসায় বা দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। সব মতেই এটি একটি করুণ ও অপমানজনক মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর তার পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়া মাত্র তিন মাসেই মৃত্যুবরণ করেন এবং উমাইয়া শাসনের এই দুষ্ট অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। (ইবনে আসাকির)

ইয়াজিদের ব্যাপারে জমহুর আহলে সুন্নতের মত হলো, ইয়াজিদ একজন ফাসেক শাসক ছিলেন। কেউ কেউ ফতোয়া দিয়েছেন তাকে কাফের বলা যাবে না, আবার তার প্রশংসাও করা যাবে না। চুপ থাকাই উত্তম। হজরত হোসাইন (রা.)-এর বিপক্ষে গিয়ে ইয়াজিদ যে অন্যায় করেছে, তাতে সে চিরকাল ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে পতিত থাকবে। (শরহুল আমালি, মোল্লা আলী কারী) তবে তাফসিরে রুহুল মাআনিতে আল্লামা আলুসি এক দীর্ঘ আলোচনায় দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছেন ইয়াজিদ নবীজির রিসালাতকে অস্বীকার করত এবং সে নিকৃষ্ট কাফেরদের একজন ছিল।

কারবালা কেবল এক ইতিহাস নয়, এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক, সত্যের জন্য আত্মোৎসর্গের চিরন্তন দৃষ্টান্ত। হোসাইন (রা.) আমাদের শিখিয়ে গেছেন, শক্তিশালী শাসক হলেও যদি সে অন্যায় করে, তবে তার সামনে মাথা নত নয় বরং সত্যের পথে দৃঢ় থাকতে হয়। আর আশুরা মানেই কেবল শোক নয়, বরং চেতনার পুনর্জাগরণ। হজরত হোসাইন (রা.) তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, আত্মত্যাগই প্রকৃত বিজয়। আমাদের উচিত তার জীবন ও আদর্শ থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং সত্য, ন্যায় ও ইসলামের মূল নীতিতে অবিচল থাকা।

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ: