ইসলামি দর্শনে ড. জাফর ইদ্রিসের অবদান
সমাজকাল
প্রকাশ: ২১:২৩, ২৮ জুলাই ২০২৫

খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রোগ্রামে দর্শনে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘দ্য কনসেপ্ট অব দ্য কজালিটি ইন ইসলাম’ তথা ইসলামে কার্যকারণ ধারণা।
সমাজকাল ডেস্ক
বিশিষ্ট ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও দার্শনিক ড. জাফর ইদ্রিস গত ১৮ জুলাই ইন্তিকাল করেছেন। তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের একজন প্রাজ্ঞ চিন্তাবিদ, শিক্ষক ও নিবেদিতপ্রাণ গবেষক।
তিনি ১৯৩১ সালের ১৫ জুন সুদানে জন্মগ্রহণ করেন। আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি তিনি কোরআন, হাদিস, ফিকহ ও আরবি ভাষা অধ্যয়ন করেন। আকিদার শিক্ষালাভ করেন আনসারুস সুন্নাহ থেকে।
ড. জাফর ইদ্রিস আমেরিকান ওপেন ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ইসলামিক অ্যান্ড অ্যারাবিক সায়েন্স ইনস্টিটিউটের রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি তিনি সৌদি আরবের ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সৌদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে আকিদা, দাওয়াহ ও মিডিয়া বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বিশ্ব জুড়ে বহু ইসলামি সংস্থার পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন।
খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রোগ্রামে দর্শনে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘দ্য কনসেপ্ট অব দ্য কজালিটি ইন ইসলাম’ তথা ইসলামে কার্যকারণ ধারণা। এ গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, ইসলামি কনসেপ্টে কারণ-প্রক্রিয়ার ধারণা ইমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং তা পরিপূরক ও পরিশীলিত।
কার্যকারণ ধারণা দ্বারা বোঝায় যে, প্রত্যেক ঘটনার একটি কারণ থাকে এবং সেই কারণের ফলেই ঘটনার সৃষ্টি হয়। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে কার্যকারণ একটি ঐশ্বরিক নিয়ম যা আল্লাহতায়ালা এই পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন। অর্থাৎ প্রতিটি ঘটনার পেছনে আল্লাহর ইচ্ছাই প্রধান, কিন্তু সেই ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কার্যকারণ সম্পর্কের মাধ্যমে। এই ধারণাটি তাকদিরের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে তাকদির মানে এই নয় যে, মানুষ কর্মহীন হয়ে বসে থাকবে। বরং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে চেষ্টা করা এবং কর্মের মাধ্যমে ফল লাভের আশায় কাজ করে যাওয়াই ইসলামের শিক্ষা। ড. জাফর ইদ্রিস এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই তার পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
কারণ ও কার্যকারণ (কজালিটি) হলো একটি প্রাচীন ও মৌলিক দার্শনিক ধারণা, যা প্রকৃতি, জীবন এবং বিশ্ববীক্ষার ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পশ্চিমা দর্শনে ডেভিড হিউম ও অ্যারিস্টটলের মতো দার্শনিকরা এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তবে ইসলামি চিন্তায় এই ধারণা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে, বিশেষ করে যে সকল চিন্তাবিদ আল্লাহর সার্বিক ক্ষমতা ও ইমানি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করেছেন। ড. জাফর ইদ্রিস এ বিষয়ের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন, যেখানে তিনি ‘কারণ’ ও ‘ফলাফল’-এর মধ্যে সম্পর্ককে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন।
ড. ইদ্রিস বলেন, ইসলাম কারণ ও কার্যকারণ সম্পর্ককে অস্বীকার করে না, তবে এটি একটি সীমিত ও শর্তাধীন বাস্তবতা হিসেবে দেখা হয়, যা আল্লাহর ইচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণাধীন। ইসলাম স্বীকার করে যে, আগুন পোড়ায়, পানি ভিজায়, ঔষধে রোগ ভালো হয়। তবে এসব প্রভাব কোনো জিনিসের নিজস্ব স্বতন্ত্র ক্ষমতা নয়, বরং মহান আল্লাহ এসব মাধ্যমের দ্বারা কার্য সম্পাদন করান। এই দৃষ্টিভঙ্গি আশআরি ও মাতুরিদি আকিদার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তিনি বলেন, কোরআনে বহু আয়াত আছে যেখানে কারণ ও ফলাফলের সম্পর্ক আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের যখন কোনো বিপদ আসে, তখন তা তোমাদের নিজেদের কাজের কারণে।’ (সুরা শুরা ৩০) এখানে কাজ (কারণ) ও বিপদ (ফলাফল) এ দুইয়ের সম্পর্ক স্বীকৃত, কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত আল্লাহর হাতে।
ড. জাফর ইদ্রিস আরও বলেন, মুসলমানদের উচিত বস্তুগত কারণকে অবহেলা না করা, বরং সেই সাথে মনে রাখা উচিত, যে ফলাফল সৃষ্টি করেন তিনি একমাত্র আল্লাহ। এটি একটি ইমানি ভারসাম্যতা, যেখানে মানুষ দুনিয়ার বাস্তব কারণগুলো গ্রহণ করে, কিন্তু নির্ভর করে আল্লাহর ওপর। তিনি এ প্রসঙ্গে হাদিস উদ্ধৃত করেন, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা ওষুধ গ্রহণ করো, কারণ আল্লাহ প্রতিটি রোগের জন্য চিকিৎসা নির্ধারণ করেছেন।’
ড. জাফর ইদ্রিস পশ্চিমা দর্শনের সমালোচনাও করেছেন, বিশেষ করে সেই জায়গায় যেখানে তারা কারণ-কার্য সম্পর্ককে কেবল বস্তুগত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেই ধরে নেয়। তিনি বলেন, এ দৃষ্টিভঙ্গি ঈশ্বরবিমুখ ও নিরীশ্বর দর্শনের জন্ম দেয়। ইসলাম এ বিষয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়, যেখানে মানুষ নিজ দায়িত্বে চেষ্টা করবে, কিন্তু এই বিশ্বাসে থাকবে যে, চূড়ান্ত ফলাফল আল্লাহর অনুমতি ছাড়া সম্ভব নয়।
ড. জাফর ইদ্রিসের ব্যাখ্যা আমাদের একটি গভীর ইমানি ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। তিনি আমাদের শেখান, চেষ্টা ও তাওয়াক্কুল একে অপরের পরিপূরক। দুনিয়ার নিয়ম ও আল্লাহর কুদরত একে অপরের বিরোধী নয়, বরং এক সূক্ষ্ম সংগতি। ইসলামে কারণ ও কার্যকারণের ধারণা কোনো যান্ত্রিক বাস্তবতা নয়, বরং তা ইমান, জ্ঞানের গভীরতা এবং মানবিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।