তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি ফের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫:০৩, ২১ অক্টোবর ২০২৫

হাইকোর্ট ভবন। ছবি: সংগৃহীত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার বিষয়ে আজ মঙ্গলবারের শুনানি শেষে সর্বোচ্চ আদালত আগামীকাল বুধবার (২২ অক্টোবর) পর্যন্ত কার্যক্রম মুলতবি করেছেন। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে এ আদেশ দেন।
এ দিন আদালতে আপিলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট ড. শরীফ ভুঁইয়া, আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
শুনানিতে ড. শরীফ ভুঁইয়া সংবিধান ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া এবং সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে কীভাবে পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলো রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল তা বিশদভাবে তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প ব্যবস্থা প্রয়োজন।
এর জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “গত দেড় দশকে দেশে শাসন ব্যবস্থার নামে শোষণ হয়েছে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমে যে পরিবর্তন এসেছে, সেটিই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বাস্তব প্রতিফলন।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিয়ে আপাত সমাধান নয়, বরং কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা গঠনের দিকেই নজর দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার বিঘ্নিত না হয়।”
তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন— যদি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়, তবে তা কোন সময় থেকে কার্যকর হবে?
১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হয়। তবে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম. সলিম উল্লাহসহ তিন আইনজীবী এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন।
২০০৪ সালে হাইকোর্ট রিট খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে। কিন্তু ২০০৫ সালে আপিল বিভাগের শুনানিতে বিষয়টি নতুন মোড় নেয়।
আদালতের নিয়োগকৃত আটজন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে পাঁচজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন— ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম, এম. আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ।
তবে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ছিলেন বাতিলের পক্ষে, আর ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির সংস্কারের প্রস্তাব দেন।
শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। এরপর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পাস হয় পঞ্চদশ সংশোধনী, যা কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও নতুন আবেদনসমূহ
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের (৫ আগস্ট ২০২৪) পর থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি জোরালো হয়।
এ প্রেক্ষিতে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম. হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভুঁইয়া ও জাহরা রহমান ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম পুনর্বিবেচনা আবেদন করেন।
এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (১৬ অক্টোবর), জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার (২৩ অক্টোবর) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথকভাবে একই আবেদন করেন।
সব মিলিয়ে চারটি রিভিউ আবেদন একত্রে শুনানির জন্য তোলা হয়। গত ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগ এসব আবেদন গ্রহণ করে আজ থেকে পূর্ণাঙ্গ শুনানি শুরু করে।
আগামী পদক্ষেপ
বুধবারের শুনানিতে আদালত আবেদনকারীদের পরবর্তী যুক্তি শুনবেন। আইনি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মামলার রায় দেশের নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে— যা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক ভারসাম্যে গভীর প্রভাব ফেলবে।