শাহজালালে অগ্নিকান্ডে ওষুধে ক্ষতি ৪ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছার শঙ্কা
১৪ বিষয়ে বিশেষ নজরদারির আহ্বান ওষুধ শিল্প সমিতির
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬:০৯, ২১ অক্টোবর ২০২৫

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ওষুধ খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারকে ১৪টি বিষয়ে বিশেষ নজর ও সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি।
সমিতি থেকে বলা হয়েছে, গত ১৮ অক্টোবর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশের ওষুধ শিল্পে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এই দুর্ঘটনায় শীর্ষ ৪৫টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে গেছে। এই এই ক্ষতি সার্বিকভাবে ৪ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।
এমন অবস্থায় দেশের ফার্মাখাতের ঝুঁকি ও ভবিষ্যত সম্ভাব্য সংকট এড়াতে এবং এই খাতের সুরক্ষায় সরকারকে বিশেষ নজর ও সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়ার আহ্বান জানান সমিতির নেতা ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তারা।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমিতির কাযালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইউনিমেড ইউনিহেলথ এর চেয়ারম্যান এম মোসাদ্দেক হোসেন ও লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সমিতির মহাসচিব ও ডেল্টা ফার্মার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডা. মো. জাকির হোসেন।
এ ব্যাপারে সমিতির মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি মানসম্পন্ন ওষুধ ১৬০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়, যার মধ্যে উন্নত দেশও রয়েছে, কিন্তু এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে উৎপাদন চেইনে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে।
তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতি দ্রুত তদন্ত, ক্ষতিপূরণের কার্যকর ব্যবস্থা এবং বিকল্প কার্গো ব্যবস্থাপনা জোরদার করার আহ্বান জানান।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গত ১৮ অক্টাবর (শনিবার) ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগিকাণ্ডর ঘটনায় ঔষধ উৎপাদনে ব্যবহ্নত বিভিন্ন কাঁচামাল ভস্মিভূত হওয়ার এই শিল্পখাতে বড় ধরনর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই আকস্মিক ক্ষতি আমাদরকদের বহুবিধ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের মানসম্পন্ন ওষুধ এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রলিয়াসহ ১৬০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়। জীবনরক্ষাকারী ঔষধ উৎপাদন এবং এপিআই উৎপাদনও বিশেষ সক্ষমতা অর্জন করেছে দেশ।
সমিতি জানায়, দেশের ঔষধ শিল্পে ব্যবহ্নত বিভিন্ন ধরণের কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশ চীন, ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানী করতে হয়। এ ছাড়াও এই শিল্পখাত ব্যবহ্নত প্যাকিং ম্যাটরিয়ালস, ক্যাপিট্যাল মেশিনারি, স্পেয়ার পার্টসও আমদানী করত হয়। আমদানীকৃত কাঁচামালের বড় অংশ বিভিন্ন ধরণের জীবনরক্ষাকারী ঔষধ প্রস্ততে ব্যবহার করা হয়। এসব জরুরি ও দামী কাঁচামাল আকাশপথে আনা হয়। বাকি যন্ত্রপাতি আনা হয় সমুদ্র পথে।
লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, দেশে বর্তমানে ৩০৭টি ঔষধ প্রস্তত কোম্পানি আছে। এর মধ্যে ২৫০টি প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাব ঔষধ উৎপাদন করে। গত ১৮ অক্টাবর কার্গো ভিলেজে অগ্নিকান্ডে দেশের শীর্ষ ৪৫টি কোম্পানির প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে গেছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো আরও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিল মোট ক্ষতির পরিমাণ আরও বশি হবে। পুড়ে যাওয়া পণ্যের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, ভ্যাকসিন, হরমোন, ডায়াবেটিক, ক্যান্সার জাতীয় ঔষধ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামালও ছিল।
সমিতি জানায়, এসব কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ার কারণে ওষুধ উৎপাদন যেমন ব্যহত হবে, তেমনি বেশকিছু স্পায়ার পার্টস ও মেশিনারিজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঔষধ প্রস্তত করে পুনরায় আমদানীতেও সময় লাগবে। এছাড়া যে সব পণ্য অন্যান্য বিমানবন্দরে নামানো হয়েছে, সেসব পন্য নিয়েও আমরা চিন্তিত। কারণ এসব কাঁচামাল বিশেষ তাপমাত্রায় রাখতে হয়, যা ওইসব বিমানবন্দরে নেই। এতেও একধরণের ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়েছি।
সমিতি বলে, অগ্নিকান্ডে পুড়ে যাওয়া পণ্যের মধ্যে একটি বড় অংশ নারকটিস বিভাগ থেকে অনুমোদন নেওয়া পণ্য। এসব পণ্য অবার আনা যেমন জটিল, তেমনি সময়সাপেক্ষ। কেননা এগুলো আনতে ধাপে ধাপে অনেক ধরণের অনুমোদন নিতে হয়। এখানেও বড় ধরনর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এসময় সমিতির মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে ওষুধ খাতে সবমিলে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে।
১৪ বিষয়ে বিশেষ নজরদারির আহ্বান
সংবাদ সম্মেলনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ফার্মাখাতের ঝুঁকি ও ভবিষ্যত সম্ভাব্য সংকট এড়াতে এবং এই খাতের সুরক্ষায় সরকারকে ১৪টি বিষয়ে বিশেষ নজর ও সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ওষুধ শিল্প সমিতি।
এগুলো হলো-
১. আগুনে পুড়ে যাওয়া যে সব পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারকে ইতোমধ্যেই শুল্ক, ডিউটি ট্যাক্স ও ভ্যাট দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যেন আমদানীকারকদের ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
২. যে সব পণ্য পুড়ে গেছে, সে সব পণ্য সংক্রান্ত এলসি সংক্রান্ত ব্যাংক চার্জ, সুদ যেন মওকুফ করা হয়।
৩. ক্ষতিগ্রস্ত মালামালসমূহ পুন: আমদানীর ক্ষেত্রে ব্যাংকসমূহ যেন কোন মার্জিন, ব্যাংক চার্জ অথবা সুদ দাবি না করে। বরং উক্ত মালামাল সহজ শর্তে এলসি ওপেন এবং এলসি রিলিজের সুযোগ দিতে হবে।
৪. অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের বিপরীতে ধার্য্যকত চার্জ/দণ্ড মওকুফ করতে হবে।
৫. বেসামরিক বিমান চলাচল এবং বাংলাদশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের আরোপযোগ্য সকল চার্জ/দণ্ডসমূহ মওকুফ করতে হব। যেমন- গোডাউন চার্জ, ডেমারেজ চার্জ, ইম্পোর্ট হ্যান্ডলিং ফি, ডেঞ্জারার্স গুডস হ্যান্ডলিং ফি এবং সংশ্লিষ্ট ভ্যাট।
৬. যেসকল মালামাল পৌঁছানোর পর অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হয়নি, সবক্ষেত্রে সব ধরণের পণ্যের বিভিন্ন ফি পরিশোধের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয়) মাস অর্থাৎ ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় দিত হব।
৭. উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য সকল কাঁচামাল আমদানি সহজীকরণ করতে হবে।
৮. ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের বিপরীত মালামাল দ্বারা উৎপাদিত ফাইনাল প্রাডাক্ট-এর ধার্য্যকত ভ্যাট মওকুফ করতে হব।
৯. নারকাটিস বিভাগ থেকে অনুমতি সাপেক্ষে আমদানীকৃত পণ্যসমূহ আগের অনুমোদনের ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ে পুনরায় আনার অনুমতি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দ্রুততম সময় পণ্য আমদানী করা সম্ভব হয়।
১০. কার্গা ভিলেজ সম্পর্কিত কাস্টম হাউসকে অফিস ছুটির পর এবং শুক্র ও শনিবারেও স্বল্প পরিসরে হলেও সক্রিয় রাখা প্রয়োজন, যাতে করে আমরা পণ্য রিলিজ করতে পারি।
১১. যে সব ও ম্যাটেরিয়ালের জন্য কোল্ডচেইন মেইনটেইন করতে হয় সেসব পণ্য দ্রুততম সময়ে রিলিজের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
১২. র্কাগো ভিলেজে যদি কোনো অক্ষত উপকরণ বা চালান পাওয়া যায়, তবে সেটি পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে ও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানগিুলোকে জানাতে হবে। চালানগুলোর দ্রুত মূল্যায়ন ও বর্ধিত সময়ে ডেলিভারির ব্যবস্থা করতে হবে। চালানের ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ণের জন্য বীমা কোম্পানি ও জরিপ কর্মকর্তাদের র্পূণ সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
১৩. যেসব এয়ারলাইনস এইচআইএসএ-তে র্কাগো নিয়ে আসে, তাদের দ্রুত কার্যক্রম শুরুর সবুজ সংকেত দিতে হবে।
১৪. ডিজিডিএ, নারকোটিকস, কাস্টমস, এনবিআর ও বিমান কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য রেগুলেটরি বোর্ডকে নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি যৌক্তিক সভা ডেকে আমাদের সমস্যা সমাধানে সুষ্ঠু পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রেনেটা লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও সৈয়দ কায়সার কবীর, সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লি. এর সিইও মুহাম্মদ হালিমুজ্জামান, সমিতির সদস্য ও নিপ্রো-জেএমআই ফার্মাসিউটিক্যালস লি. এর এমডি আব্দুর রাজ্জাক, সমিতির সদস্য ও একমি ল্যাবরোটারিজ লি. এর পরিচালক ফাহিম সিনহা,সমিতির সদস্য ও ওয়ান ফার্মার ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোস্তাফিজুর রহমান, সমিতির সদস্য ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লি. এর নির্বাহি পরিচালক মিজানুর রহমান ও সমিতির সিইও মে. জে (অব.) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।