মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

| ১৪ আশ্বিন ১৪৩২

মার্কিন সেনার মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনা ও ইসলাম গ্রহণ

মাইসারা জান্নাত

প্রকাশ: ০০:১২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মার্কিন সেনার মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনা ও ইসলাম গ্রহণ

রিচার্ড ম্যাককিনি প্রাক্তন মার্কিন মেরিন ভেটেরান। তিনি আশির দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন মেরিন কোরে যোগদান করেন। পরবর্তীতে সামরিক বাহিনী ও আর্মি রিজার্ভে প্রায় ২৫ বছর কাজ করেন। ইরাক ও আফগানিস্তানে একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর ২০০৩ সালে তিনি আহত হন এবং ২০০৬ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেন। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও মানসিক আঘাতের কারণে তিনি পিটিএসডিতে (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) ভোগেন। এতে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণার অনুভূতি তৈরি হয়। এমন অবস্থায় তিনি ইন্ডিয়ানার মুনসিতে একটি মসজিদে বোমা হামলার পরিকল্পনা করেন।

তিনি ইরাক ও আফগানিস্তানে মুসলমানদের দেখেছেন শত্রুর চোখে। দেশে ফিরে সেই মানসিকতা তাকে আরও কঠিন করে তোলে। মুনসির রাস্তায়, বাজারে কিংবা স্কুলের সামনে মুসলিম পরিবারগুলোকে দেখলে তার মনে হতো, ‘এসব লোক আমার দেশের শত্রু। তারা এখানে কী করছে?’ সেই ক্রোধ একসময় তাকে ঠেলে দেয় ভয়াবহ পরিকল্পনার দিকে। তিনি স্থানীয় মসজিদে বোমা হামলার ইচ্ছা করেন।

তবে হামলার আগে তিনি ভাবলেন, একবার ভেতরটা দেখে আসা যাক। এক বিকেলে পা রাখলেন মসজিদের দরজায়। উদ্দেশ্য ছিল কেবল নিজের শত্রুতার যুক্তি খোঁজা। কিন্তু দরজার ওপারে যা তার জন্য অপেক্ষা করছিল, তা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

মসজিদের মানুষগুলো তাকে স্বাগত জানালেন অকৃত্রিম হাসি দিয়ে। চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে এলেন কেউ, আবার কেউ খোঁজ নিলেন তার শরীর-স্থাস্থ্যের। রিচার্ড অবাক হয়ে গেলেন। যাদের তিনি শত্রু মনে করেছেন, তাদের আচরণে তো নেই কোনো বৈরিতা। বরং আছে আন্তরিকতা, উষ্ণতা ও ভালোবাসা। কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ মসজিদে যেতে যেতে তার মনে জমে থাকা অন্ধকার আস্তে আস্তে দূর হতে থাকে।

রিচার্ড নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন, ‘যাদের আমি ধ্বংস করতে চাই, তারাই তো আমাকে আপন করে নিচ্ছে। আমি কি এতদিন ভুল করে এসেছি?’ সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজে পেলেন ইসলামের শিক্ষা ও মুসলিমদের জীবনের সরলতায়। একদিন তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন।

রিচার্ডের এই সিদ্ধান্ত শুধু তার নিজের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়নি, বদলে দিয়েছিল পুরো সম্প্রদায়কে। যিনি একসময় মসজিদ ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, পরবর্তীতে সেই মসজিদের অন্যতম সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন। এমনকি একসময় তাকে নির্বাচিত করা হয় মসজিদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। শত্রু থেকে অভিভাবক, এ এক অবিশ্বাস্য রূপান্তরের কাহিনি।

এই কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে মুনসির সীমানা পেরিয়ে গোটা আমেরিকায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে রিচার্ডের সাক্ষাৎকার, টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উঠে আসে তার অনন্য যাত্রা। তার এই পরিবর্তনের গল্প ২০২২ সালে 'স্ট্রেঞ্জার অ্যাট দ্য গেট' নামে একটি শর্ট ডকুমেন্টারিতে তুলে ধরা হয়, যা অস্কারে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্রের জন্য মনোনীত হয়েছিল। বিশ্ব জুড়ে মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে, কীভাবে একজন মানুষ ঘৃণা থেকে ফিরে এসে ভালোবাসা ও শান্তির প্রতীক হতে পারেন।

রিচার্ড ম্যাককিনির গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবতার আলো যেকোনো অন্ধকারকে ভেদ করতে পারে। ভুল ধারণা মানুষকে যতই পথভ্রষ্ট করুক না কেন, সত্যিকারের ভালোবাসা আর আন্তরিক ব্যবহার হৃদয়কে পাল্টে দিতে পারে।

বর্তমানে রিচার্ড ম্যাককিনি ঘৃণা থেকে ভালোবাসায় তার রূপান্তরের গল্প শেয়ার করে সমাজে শান্তি ও সহনশীলতার বার্তা পৌঁছানোর কাজ করছেন। তার জীবন ও পরিবর্তনের গল্প একটি প্রমাণ যে, মানবতা ও ভালোবাসা সব বাধা অতিক্রম করতে পারে।

মুনসির সেই ছোট্ট মসজিদ সাক্ষী এক সাবেক সৈনিকের হৃদয় বদলের, যিনি একসময় মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন, পরে তিনি সেই মসজিদেরই প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

আরও পড়ুন