মানবচরিত্রের কেন্দ্রবিন্দু হৃদয়
মাইসারা জান্নাত
প্রকাশ: ২২:৫৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হৃদয় মানুষের প্রকৃত সত্তা, নৈতিকতার কেন্দ্র এবং আধ্যাত্মিক জগতের আসন। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে একাধিকবার হৃদয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কখনো হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন, প্রশান্ত, বিনীত ও অনুগত হিসেবে বর্ণনা করেছেন, আবার কখনো অসুস্থ, অন্ধ ও মোহরকৃত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, আল্লাহ মানুষের হৃদয়ে এমন এক শক্তি দিয়েছেন, যা তাকে ইমানের পথে আলো দান করতে পারে, আবার অবিশ্বাস ও অজ্ঞতার অন্ধকারেও ডুবিয়ে দিতে পারে। সুতরাং মানবচরিত্রের কেন্দ্রবিন্দু হৃদয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) হৃদয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের দেহে একটি অঙ্গ আছে, যা ভালো থাকলে সমগ্র দেহ ভালো থাকে, আর তা নষ্ট হলে পুরো দেহ নষ্ট হয়ে যায়। সেটিই হলো কলব বা হৃদয়। (সহিহ মুসলিম) এই বাণী প্রমাণ করে, চরিত্র গঠন, আমল ও নৈতিকতার মূল শেকড় আসলে হৃদয়ের ভেতরেই নিহিত। তাই হৃদয়ের অবস্থা যেমন হবে, তেমনই হবে মানুষের জীবন, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ।
তবে এ প্রশ্নও রয়েছে যে, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার আসন কোথায়? হৃদয়ে নাকি মস্তিষ্কে? ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে মস্তিষ্ক হলো বুদ্ধির আধার, আর ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেছেন হৃদয়েই নিহিত রয়েছে মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আসলে এ দুটিই পরস্পরের পরিপূরক। মস্তিষ্ক চিন্তার দ্বার খুলে দেয়, আর হৃদয় সেই চিন্তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। হৃদয় যদি কলুষিত হয়, তবে জ্ঞানও সঠিকভাবে কাজে আসে না। আবার হৃদয় পরিশুদ্ধ হলে মস্তিষ্কের জ্ঞান আলোকিত হয়।
কোরআনে হৃদয়ের ইতিবাচক দিক যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি নেতিবাচক দিকও স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। অনুগত, প্রশান্ত, বিনীত, মুত্তাকি ও প্রাণবন্ত হৃদয় মানুষের ইমানকে সুদৃঢ় করে, তাকে আল্লাহর নৈকট্যের দিকে এগিয়ে দেয়। অন্যদিকে অসুস্থ, অন্ধ, অহংকারী, কঠোর কিংবা মোহরকৃত হৃদয় মানুষকে পথভ্রষ্ট করে এবং তাকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে এসব চিত্র অঙ্কন করেছেন, যাতে মানুষ নিজের অন্তরের অবস্থা চিনতে পারে এবং কলুষিত হৃদয়কে শুদ্ধ করার চেষ্টা চালায়।
হৃদয় যখন আল্লাহর স্মরণে প্রশান্ত হয়, তখন তার প্রতিফল পড়ে মানুষের আচার-আচরণে, পারস্পরিক সম্পর্কে এবং সমাজ জীবনে। সে হৃদয় দয়া, করুণা, বিনয় ও তাকওয়ার আলো ছড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে যে হৃদয় উদাসীন, পাপাচারে আসক্ত ও অহংকারে ভরা, তার প্রতিফল দেখা যায় নৈতিক অবক্ষয়ে, অন্যায়ের বিস্তারে এবং আত্মার অশান্তিতে। তাই হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক ও সামষ্টিক কল্যাণের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
অতএব, কোরআনের আলোকে হৃদয়ের বিভিন্ন অবস্থার আলোচনা মানুষের জন্য শিক্ষা ও সতর্কবার্তা। এটি শুধু তত্ত্ব নয়, বরং আমলের আহ্বান। যে মুমিন নিজের হদয়কে পরিশুদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়, তার জীবন আলোকিত হয়, সমাজ সুন্দর হয় এবং আখেরাতে মুক্তি নিশ্চিত হয়। তাই আমাদের কর্তব্য হলো, হৃদয়ের অবস্থা নিয়ে সচেতন থাকা এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করা, তিনি যেন আমাদের হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন, প্রশান্ত ও অনুগত হিসেবে গড়ে তুলেন।