মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

| ১৪ আশ্বিন ১৪৩২

আইসিডিডিআর,বির গবেষণা

১৮ বছরের আগেই অন্তঃসত্ত্বা ৬৫% পোশাককর্মী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২:৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২২:৪৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

১৮ বছরের আগেই অন্তঃসত্ত্বা ৬৫% পোশাককর্মী

দেশের পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মধ্যে প্রতি তিনজন নারীর দুজনের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী ১৮ বছর হওয়ার আগেই প্রথম গর্ভধারণ করছেন।

এ ছাড়াও প্রায় প্রতি তিনজনে একজন নারীশ্রমিক জীবনে অন্তত একবার অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হচ্ছেন এবং প্রতি চারজনে একজনের গর্ভপাত বা মেনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত (গার্মেন্ট) নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিয়ে করা আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীতে আইসিডিডিআর,বির মহাখালী ক্যাম্পাসের সাসাকাওয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এই গবেষণার ফল উপস্থাপন করা হয়। এটি গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সহায়তায় অ্যাডসার্চ বাই আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত ২৪ মাসব্যাপী কোহর্ট গবেষণা। এই ধরনের গবেষণা বাংলাদেশে এই প্রথম বলে জানায়  আইসিডিডিআর,বি।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গবেষণাটি কড়াইল ও মিরপুর বস্তি এবং গাজীপুরের টঙ্গী বস্তিতে আইসিডিডিআর,বি-র আর্বান হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভেইলেন্সের আওতাধীন এলাকায় পরিচালিত হয়েছে। তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত ১৫-২৭ বছর বয়সী মোট ৭৭৮ শ্রমিককে  সাথে নিয়ে প্রতি ছয় মাস পর পর জরিপের মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়।  

বাড়ছে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গবেষণার শুরুতে ৪৯ শতাংশ নারী তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা ছিল। দুই বছর পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশে।

একইভাবে শুরুতে জরুরি গর্ভনিরোধক বড়ি/ট্যাবলেট সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন ১৫ শতাংশ নারী, পরে তা বেড়ে হয়েছে ৩৯ শতাংশ। 

একই সময়ে পরিবার পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মতামতের প্রাধান্য দেয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ৫৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে।

সহিংসতা বেড়েছে ঘরে ও কর্মস্থলে

গবেষণায় বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকরা ঘর ও কর্মস্থল দুই জায়গায়ই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। গত ১২ মাসে নারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে তাদের স্বামীর সহিংসতার হার ছিল অনেক বেশি। এসময় যৌন সহিংসতা ছাড়া অন্য সব ধরণের সহিংসতা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার হার।

গবেষণায় দেখা গেছে, গবেষণার শুরুতে প্রায় ৪৮ শতাংশ নারী গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন, দুই বছর পর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশে।

উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সহিংসতার শিকার নারীরা প্রায় কেউই আনুষ্ঠানিক সাহায্য চাইতে যান না। শুরুতে ৩৫ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক (পরিবার বা বন্ধুদের কাছে) সাহায্য চেয়েছিলেন, কিন্তু এই হার ক্রমশ কমে ২ বছর শেষে দাঁড়ায় মাত্র ২১ শতাংশে। কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার ঘটনায়ও মাত্র প্রতি ৫জন নারীর মধ্যে একজন নারী শুরুতে কর্তৃপক্ষকে সহিংসতার কথা জানিয়েছিলেন এবং ২ বছর পরে এসেও এই চিত্রে কোন পরিবর্তন হয়নি।

২২% কারখানায় স্যানিটারি প্যাড

পোশাক কারখানাগুলোতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু পরামর্শমূলক সেবা থাকলেও দরকারি সরবরাহ সীমিত। জরিপে অংশ নেয়া শ্রমিকরা যেসকল কারাখানায় কাজ করেন, সেগুলোর মধ্যে শুধু ২২ শতাংশ কারখানায় স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায় এবং মাত্র ১৪ শতাংশ কারখানায় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সরবরাহের তথ্য মিলেছে। 

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় গর্ভধারণের ঝুঁকি কম

কিশোরী গর্ভধারণের মূল নিয়ামকগুলো নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে, নারী তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে যারা অন্তত ৯ বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং তুলনামূলক বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন, তাদের কিশোরী বয়সে (১৫-১৯ বছর) গর্ভধারণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। যারা সন্তান ধারণের আগেই গর্ভনিরোধক ব্যবহার শুরু করেছিলেন, তাদের কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি ৪৭ শতাংশ কম পাওয়া গেছে। আবার যারা প্রথম গর্ভধারণের আগে তৈরি পোশাক শিল্পখাতে কাজ শুরু করেছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি আরও কম ছিল। অন্যদিকে, স্বামীর দ্বারা সহিংসতার অভিজ্ঞতা থাকলে কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।  

ক্ষমতায়ণে বেশি সুরক্ষা

গবেষণায় বলা হয়েছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বেশি থাকলে মানসিক ও যৌন সহিংসতা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। আবার মতামত প্রকাশের ক্ষমতা থাকলে যৌন সহিংসতা কমে। যে নারী শ্রমিকের চলাচলে স্বাধীনতা বেশি তার শারীরিক সহিংসতার ঝুঁকি কম। ফলাফল বলছে, এ ধরণের ক্ষমতায়নের মাত্রা যত বাড়বে, নারী গার্মেন্ট শ্রমিকরা সহিংসতা থেকে তত বেশি সুরক্ষা পাবেন। 

সংকট সমাধানে পরামর্শ

গবেষণার প্রধান গবেষক আইসিডিডিআর,বি’র ইমিরেটাস সায়েন্টিস্ট ড. রুচিরা তাবাসসুম নভেদ বলেন, “অর্থনৈতিক দিক থেকে তুলনামূলক এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অবস্থা অন্য নারীদের চেয়েও খারাপ। পরিস্থিতি উন্নয়নের নিয়ামকগুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা দরকার। এ জন্য সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও অংশীদারদের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।”

বিকেএমইএ’র যুগ্ম সম্পাদক ফারজানা শারমিন বলেন, “যেহেতু সমাজ ব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক, তাই নারীদের জন্য 'ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স' ধরে রাখা বেশ কঠিন। গর্ভধারণের মতো বিষয়েও তাদের মতামতের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। এই পরিস্থিতিতে, কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকার একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা নিতে পারে। কর্মীদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো সহজলভ্য করা এবং এই বিষয়ে তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অন্যদিকে, সরকারি ক্লিনিকগুলোর সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট কার্যসময়ের কারণে কর্মরত নারীরা সেবা গ্রহণের সুযোগ পান না, যা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।”

মেরি স্টোপেস বাংলাদেশের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও স্বাধীন গবেষক ইয়াসমিন এইচ আহমেদ বলেন, “নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা এখনো দোকানে গিয়ে স্বল্পমেয়াদী জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী ক্রয় করতে পারে না। তাই গার্মেন্টগুলোতে কাউন্সেলিং এর পাশাপাশি সাধারণ জন্মবিরতিকরণ সামগ্রীগুলো নিশ্চিত করতে হবে।”

পপুলেশন কাউন্সিল বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক ড.উবাইদুর রব বলেন, “নারীদের কর্মক্ষেত্র এখন কেবল গার্মেন্টেই সীমাবদ্ধ নেই। তবে যেখানেই কাজ করুক না কেন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমাতে হবে। এজন্য কর্মীদের জ্ঞান বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, অধিকার ও নিরাপত্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে সঠিক নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নে সহায়ক হবে।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন