বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫

| ১২ ভাদ্র ১৪৩২

নাকের মিউকাস বা সর্দি কী বলছে আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে

সমাজকাল

প্রকাশ: ১৬:৪৬, ১০ জুলাই ২০২৫

নাকের মিউকাস বা সর্দি কী বলছে আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে

সমাজকাল ডেস্ক নাকের মিউকাস বা সর্দি কী বলছে আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে, নাক থেকে বের হওয়া সর্দি বা মিউকাস শুধু বিরক্তিকর নয়—এটি আমাদের শরীর রক্ষার এক বিস্ময়কর উপাদান। এর রং ও ঘনত্ব দেখে অনেক সময় আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিসে, সর্দিকে মানবদেহের চারটি প্রধান তরল উপাদানের একটি মনে করা হতো—যা মানুষের স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিত্ব নিয়ন্ত্রণ করত বলে বিশ্বাস করা হতো। চিকিৎসক হিপোক্রেটিসের মতে, এই চারটি “হিউমার” বা রস হলো: রক্ত, শ্লেষ্মা (ফ্লেম), হলুদ পিত্ত ও কালো পিত্ত। এই উপাদানগুলোর ভারসাম্যহীনতা নানাবিধ অসুস্থতার কারণ হতে পারত। যেমন, ফ্লেম বা শ্লেষ্মা মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে তৈরি হয় এবং ঠান্ডা ও ভেজা ঋতুতে এটি অতিরিক্ত পরিমাণে তৈরি হয়ে মৃগী রোগ পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারত। তবে আজ আমরা জানি, সর্দি আমাদের ব্যক্তিত্ব বদলায় না, বরং এটি আমাদের রোগ থেকে রক্ষা করে। নাক দিয়ে হাঁচি বা সর্দি পড়া যতই বিরক্তিকর মনে হোক না কেন, এই তরল পদার্থটি আমাদের দেহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। এর বিশেষ গঠন ও উপাদান আমাদের শরীরের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। এখন বিজ্ঞানীরা চাইছেন এই সর্দিকে ব্যবহার করে কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের সমস্যার মতো নানা অসুখ নির্ণয় ও চিকিৎসায় সহায়তা নিতে। এই সর্দি নাকের অভ্যন্তরকে আর্দ্র রাখে এবং বাহ্যিক পরিবেশ থেকে আসা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ধুলাবালি ও দূষণকে আটকে দেয়। শত শত ক্ষুদ্র লোমের সাহায্যে এটি বাইরের জগতের সঙ্গে শরীরের ভেতরের সীমান্তরক্ষীর ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন কতটা সর্দি তৈরি হয়? একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীর প্রতিদিন ১০০ মিলিলিটারের বেশি সর্দি তৈরি করে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ আরও বেশি, কারণ তাদের শরীর তখনও নতুন জীবাণু ও পরিবেশের উপাদানের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখছে বলে জানান ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের রেসপিরেটরি ইনফেকশন ও ভ্যাকসিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড্যানিয়েলা ফেরেইরা। সর্দির রং দেখে সহজেই কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় শরীরের অবস্থা সম্পর্কে: স্বচ্ছ সর্দি: সাধারণত এলার্জি বা ধুলাবালির প্রতিক্রিয়ায় শরীর যা কিছু অস্বস্তিকর সেটা বের করে দিচ্ছে। সাদা সর্দি: ভাইরাসের উপস্থিতি নির্দেশ করে। সাদা রং হয় সাদা রক্তকণিকার কারণে। হলুদ-সবুজ সর্দি: সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মৃত সাদা রক্তকণিকা জমে এই রং হয়। লালচে বা গোলাপি সর্দি: নাকের ভেতর ক্ষতের কারণে অল্প রক্ত মিশে যেতে পারে। সর্দির জীবাণুব্যবস্থা আমাদের অন্ত্রে যেমন মাইক্রোবায়োম (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাকের মিশ্র উপনিবেশ) রয়েছে, তেমনি নাকের সর্দির ভেতরেও রয়েছে এক বিস্তৃত জীবজগৎ—যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। ফেরেইরার মতে, হিপোক্রেটিসের ধারণা পুরোপুরি ভুল ছিল না—কারণ, যদিও মিউকাস নিজে অসুখ তৈরি করে না, এটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে। আমরা যখন হাঁচি দিই, নাক মুছি, কিংবা হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করি—তখন এই জীবাণু অন্যদের কাছেও ছড়াতে থাকে। অর্থাৎ, সর্দি একরকম রোগ বিস্তারের গোপন বাহন। প্রতিটি মানুষের সর্দির মাইক্রোবায়োম একে অপরের থেকে আলাদা। এটি নির্ভর করে তার বয়স, লিঙ্গ, খাদ্যাভ্যাস, কোথায় বাস করে, এমনকি সে ভেপ করে কি না তার উপরও। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, “স্ট্যাফিলোককাস” ব্যাকটেরিয়ার মতো ক্ষতিকর জীবাণু নাকে বেঁচে থাকতে পারবে কি না, তা নির্ভর করে সর্দির ব্যাকটেরিয়াগুলোর লৌহ-আবদ্ধ করার ক্ষমতার উপর। সর্দি দিয়ে চিকিৎসা! ফেরেইরা ও তার দল এখন “ভাল ব্যাকটেরিয়ার” মিশ্রণে সমৃদ্ধ একটি সর্দি তৈরি করছেন, যা দৈনন্দিন নাকের স্প্রে হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এটি ঠিক যেন অন্ত্রের প্রোবায়োটিকের মতো, যা নাকের স্বাস্থ্যে সহায়তা করবে। তার দল ইতোমধ্যে সেরা সর্দি-মাইক্রোবায়োমের ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করেছে এবং তা মানুষের নাকে প্রয়োগ করে স্বাস্থ্যউন্নয়নের চেষ্টা করছে। সুইডেনে সর্দির ট্রান্সপ্লান্ট! সুইডেনের গবেষকেরা একধাপ এগিয়ে গিয়ে এমনকি সুস্থ মানুষের সর্দি অসুস্থদের নাকে প্রয়োগ করেছেন। ক্রনিক ব্লকড নাক বা হেই ফিভারে ভোগা ২২ জন প্রাপ্তবয়স্ক রোগীকে ৫ দিনের জন্য প্রতিদিন সুস্থ বন্ধুবান্ধবের সর্দি নাকে নেয়ার জন্য বলা হয়। দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ১৬ জনের উপসর্গ প্রায় ৪০% কমেছে। সর্দি ও ব্যক্তিগত চিকিৎসা ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির অটোল্যারিংগোলজিস্ট জেনিফার মুলিগান সর্দি ব্যবহার করে দীর্ঘস্থায়ী রাইনোসাইনুসাইটিস রোগীদের গবেষণা করছেন। আগে যেখানে অস্ত্রোপচার করে নাকের টিস্যু নিতে হতো, এখন সর্দি দিয়েই সে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সঠিক চিকিৎসা বাছাইয়ে এটি চিকিৎসকদের অনেক সময় খরচ বাঁচাচ্ছে। বর্তমানে তার গবেষণার উপর ভিত্তি করে একাধিক ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। ২০২৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা “Diag-Nose” নামে একটি কোম্পানি চালু করেছে, যারা সর্দি বিশ্লেষণকারী এআই পদ্ধতি ও FDA অনুমোদিত নাসাল মাইক্রোস্যাম্পলিং ডিভাইস চালু করেছে। ভবিষ্যৎ চিকিৎসা কীভাবে বদলাবে সর্দি? ভিটামিন ডি স্প্রে ব্যবহার করে ধূমপানে গন্ধশক্তি হারানো ব্যক্তিদের ঘ্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনার কাজ করছে এক গবেষক দল IL-26 নামক প্রোটিন সনাক্ত করে নির্ণয় করা যাচ্ছে কে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজে (COPD) আক্রান্ত হবেন সর্দি ব্যবহার করে অ্যাজমা, ফুসফুস ক্যানসার, আলঝেইমার, পারকিনসন, এমনকি দূষণজনিত ভারী ধাতু সনাক্ত করাও সম্ভব মুলিগান বলেন, "সর্দিই ভবিষ্যতের ব্যক্তিগত চিকিৎসার চাবিকাঠি। আমি নিঃসন্দেহে তা বিশ্বাস করি।" বিবিসি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ: