প্রাথমিক–মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত, বিপর্যস্ত শিক্ষাপঞ্জি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:৪৬, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
দেশের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা টানা কর্মবিরতি পালন করছেন। এর সরাসরি প্রভাবে আজ থেকে শুরু হতে যাওয়া প্রাথমিকের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। একই সঙ্গে মাধ্যমিক স্তরের চলমান বার্ষিক পরীক্ষা ও এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষাও না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। দুই স্তরের শিক্ষকদের পৃথক ৩ দফা ও ৪ দফা দাবিতে চলমান কর্মবিরতির ফলে সারাদেশে পরীক্ষার সূচি কার্যত ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এই অচলাবস্থা শিক্ষাপঞ্জিকে নতুন করে বিপর্যস্ত করছে।
এ অবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সারা বছর পরীক্ষা–কেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে শেষ মুহূর্তে এসে তারা চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
একদিকে শিক্ষকরা বলছেন, বেতন–গ্রেড, পদোন্নতি, কর্মপরিবেশসহ দীর্ঘদিনের ন্যায্য দাবি সরকারি পর্যায়ে উপেক্ষিত। অন্যদিকে অভিভাবকরা বলছেন, দাবি থাকা স্বাভাবিক হলেও তার জন্য বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন বন্ধ রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষার্থীদের ওপরে যে মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে, তার দায় নেওয়ার মতো কেউ নেই বলেও তারা অভিযোগ করেন।
সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকরা আলাদা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করলেও এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে দুই স্তরের শিক্ষকরা কার্যত একই সময়ে কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনে একাত্ম হয়ে পড়েছেন।
একদিকে ৩ দফা দাবিতে সাড়ে তিন লাখ প্রাথমিক শিক্ষক টানা কর্মবিরতি চালাচ্ছেন; অন্যদিকে ৪ দফা দাবিতে মাধ্যমিক শিক্ষকরা ১ ডিসেম্বর থেকে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে বার্ষিক পরীক্ষা, নির্বাচনী পরীক্ষা এবং এসএসসির প্রস্তুতি–সূচিও হুমকির মুখে পড়েছে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষাপঞ্জিতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে।
গত সপ্তাহে মাধ্যমিক শিক্ষকদের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সদস্যরা ৯ম গ্রেডে এন্ট্রি, ক্যাডারভুক্তি, টাইম–স্কেল, পদোন্নতি এবং বকেয়া আর্থিক সুবিধার দাবিতে টানা দুই দিন শিক্ষাভবন ঘেরাও করেন। কোনো সমাধান না আসায় তারা ঘোষণা দেন—১ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন, এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা না নেওয়া এবং খাতা মূল্যায়ন স্থগিত রাখার।
শিক্ষক নেতারা বলছেন, বছরের পর বছর কেবল আশ্বাস পেলেও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই কঠোর কর্মসূচিতে যেতে হচ্ছে। সরকার দ্রুত দাবিগুলো পূরণ করলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও পরীক্ষা নিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই ফল প্রকাশে তারা প্রস্তুত—এমনটিও জানিয়েছেন তারা।
এদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন লাখেরও বেশি সহকারী শিক্ষক বেতন–স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ, ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড সমস্যার সমাধান, এবং শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির ৩ দফা দাবিতে ২৭ নভেম্বর থেকে টানা কর্মবিরতি পালন করছেন। দাবি না মানলে বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের কথাও তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
সংগঠনের আহ্বায়করা জানিয়েছেন—সরকার চাইলে একদিনেই সমাধান সম্ভব। অর্থ বিভাগের সচিবও আলোচনায় একই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। রবিবার (৩০ নভেম্বর) রাতে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তিন দফা দাবিতে চলমান কর্মবিরতি ‘সরকারি চাকরি আইন’ এবং ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা’র পরিপন্থী।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ১ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কর্মবিরতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবে। দাবি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
পে-কমিশনে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম চলমান আছে বলেও জানানো হয়। শিক্ষকরা যেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনায় কর্মসূচি থেকে বিরত থাকেন—এমন আহ্বানও আসে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণার পর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। ১ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সব পরীক্ষা নির্বিঘ্নে আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। গাফিলতি পেলে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
একইভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলে বার্ষিক, নির্বাচনী ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা যথাসময়ে সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে। পরীক্ষায় দায়িত্বহীনতা শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে বলেও জানানো হয়েছে।
টানা কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা গভীর উদ্বেগে আছেন। পুরো বছর ধরে প্রস্তুতি নেওয়া শিক্ষার্থীরা শেষ মুহূর্তে এসে মানসিক চাপের মুখে পড়ছে। অভিভাবকরা বলছেন—দাবি থাকতেই পারে, কিন্তু বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন বন্ধ করা শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার।
অনেকে এটিকে সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতাকে আরও গভীর করবে বলেও মনে করছেন।
অভিভাবকদের আহ্বান-অবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান, যাতে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ও মানসিক স্থিতি বিপর্যস্ত না হয়।
মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, “আমরা শিক্ষকদের দাবির গুরুত্ব বুঝি; কিন্তু শিক্ষার্থীর স্বার্থ আমাদের কাছে সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। চলমান বার্ষিক ও নির্বাচনী পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আমরা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষার্থীর মানসিক স্থিতিশীলতা ও ন্যায্য মূল্যায়ন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষকরা একাডেমিক কার্যক্রম সচল রাখবেন বলেই আমরা আশা করি।”
