শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

| ৩ কার্তিক ১৪৩২

জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুরায়ামা মারা গেছেন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭:৫০, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুরায়ামা মারা গেছেন

ছবি : রয়টার্স

জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তোমিইচি মুরায়ামা শুক্রবার মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০১ বছর। নিজের জন্মস্থান ওইতা প্রিফেকচারের এক হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুসংবাদটি নিশ্চিত করেছেন জাপানের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান মিজুহো ফুকুশিমা।
মুরায়ামা ১৯৯৪ সালের জুন থেকে ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন তার দলটির নাম ছিল জাপান সোশ্যালিস্ট পার্টি।

‘মুরায়ামা বিবৃতি’: যুদ্ধাপরাধের জন্য ঐতিহাসিক ক্ষমা
তার সবচেয়ে স্মরণীয় কৃতিত্ব হলো ১৯৯৫ সালের “মুরায়ামা বিবৃতি”—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আগ্রাসী ভূমিকার জন্য এশিয়ার দেশগুলোর কাছে গভীর অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনা।

১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পণের ৫০ বছর পূর্তিতে তিনি বলেন, “অতীতে এক সময়ে জাপান ভুল জাতীয় নীতির কারণে যুদ্ধের পথে পা বাড়িয়েছিল, এবং তার ঔপনিবেশিক শাসন ও আগ্রাসনের মাধ্যমে অনেক দেশের মানুষের, বিশেষত এশীয়দের, অগণিত ক্ষতি ও কষ্টের কারণ হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন এমন ভুল আর না হয়, সেই আশায় আমি বিনয়ের সঙ্গে ইতিহাসের এই অকাট্য সত্যগুলো স্বীকার করছি এবং গভীর অনুশোচনার সঙ্গে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

এই বিবৃতিই পরবর্তী প্রায় দুই দশক ধরে জাপানের যুদ্ধ-অতীত বিষয়ে সরকারি অবস্থানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

মুরায়ামা শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে উঠে আসেন এবং ১৯৭২ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি নিজের দলের দীর্ঘদিনের অবস্থান—জাপান-আমেরিকা নিরাপত্তা জোট ও আত্মরক্ষাবাহিনী  নিয়ে বিরোধিতা—থেকে সরে এসে উভয়কেই সংবিধানসম্মত হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এতে তাঁর দলের অনেক সদস্য ক্ষুব্ধ হন।

১৯৯৫ সালে তার মেয়াদকালে দুটি বড় বিপর্যয় জাপানকে নাড়িয়ে দেয়—কোবের ভয়াবহ ভূমিকম্প (৬,৪০০ নিহত) এবং টোকিও মেট্রোতে সারিন গ্যাস হামলা (১৩ নিহত, ৬,০০০ আহত)। এসব ঘটনার ধীর প্রতিক্রিয়ার কারণে তাঁর সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।

১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে, নতুন বছরের ছুটি শেষে কাজ শুরু করার পর হঠাৎই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। বলেছিলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তির এই বছরটিতে আমি যা পারি করেছি,” এবং নববর্ষের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানান।

২০০০ সালে অবসর নেওয়ার পরও মুরায়ামা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। জাপানের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের যুদ্ধের দায় এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতার তীব্র সমালোচক ছিলেন তিনি।

তিনি বিশেষভাবে নিন্দা জানিয়েছিলেন জাপানের সেই সরকারি অবস্থানের, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনাদের জন্য জোরপূর্বক যৌনদাসী বানানো নারীদের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।

২০২০ সালে তিনি বলেছিলেন, “যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত বা মুক্তিযুদ্ধ বলা, অথবা এটিকে আগ্রাসন নয় বলে দাবি করা—এমন দৃষ্টিভঙ্গি কেবল চীন বা দক্ষিণ কোরিয়া নয়, আমেরিকা ও ইউরোপের কাছেও অগ্রহণযোগ্য।”

জীবনের শেষ পর্যন্ত মুরায়ামা বিশ্বাস করতেন, জাপানের উচিত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। তিনি বলেছিলেন—“চীনের প্রতি আমাদের দেশের আগ্রাসন তাদের অপরিমেয় ক্ষতি করেছে। এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতি আনতে হলে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির স্তরে স্থায়ী সহযোগিতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।”

তোমিইচি মুরায়ামা ছিলেন সেই বিরল রাজনীতিকদের একজন, যিনি ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও বিনয়, দায়বোধ ও মানবিকতার পাঠ দিয়ে গেছেন ইতিহাসে।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন