কমরেড মণি সিংহ : বঞ্চিতের মুক্তির লাল পতাকাধারী এক বিপ্লবী
সমাজকাল
প্রকাশ: ০২:৪৭, ২৮ জুলাই ২০২৫

জন্মদিনে যাঁদের মনে রাখি
কমরেড মণি সিংহ : বঞ্চিতের মুক্তির লাল পতাকাধারী এক বিপ্লবী
২৮ জুলাই ১৯০১ সালে ব্রিটিশ ভারতের নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণ করা কমরেড মণি সিংহ ছিলেন বাংলার বামপন্থী রাজনীতির এক অবিসংবাদিত নেতা ও আপসহীন বিপ্লবী। জন্মনাম মণীন্দ্রনাথ সিংহ হলেও সর্বজনবিদিত তিনি “কমরেড মণি সিংহ” নামেই। তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রাম ছিল কৃষক-শ্রমিক-নির্যাতিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উৎসর্গীকৃত।
শৈশবে বাবাকে হারিয়ে মা সরলা দেবীর সঙ্গে সুসং দুর্গাপুরে আসেন তিনি। কৈশোরেই জাতীয় রাজনীতির প্রভাব তাঁর ওপর পড়ে। ১৯২১ সালে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হলেও, অচিরেই তিনি শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। কলকাতার মেটিয়াবুরুজে শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে তিনি গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে ১৯৩০ সালে গ্রেপ্তার হন এবং একাধিকবার জেল-জুলুমের শিকার হন।
কমরেড মণি সিংহ সর্বদা কৃষক ও খেটেখাওয়া মানুষের অধিকার আদায়ের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুরে ‘টংক প্রথা’র বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন তাঁর নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়। তিনি ছিলেন নিখিল ভারত কৃষাণ সভা, পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সভা এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কৃষক সংগ্রামের পুরোভাগে থাকা এক সাহসী বিপ্লবী। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক ছিলেন তিনি।
পাকিস্তান আমলেও তাঁর ওপর দমন-পীড়ন থেমে থাকেনি। প্রায় ২০ বছর আত্মগোপনে থেকে, নানা ছদ্মনামে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও পরিচালনা করেন তিনি। তাঁর মাথার ওপর বরাবরই গ্রেপ্তারের হুমকি ঝুলেছে, এমনকি তাঁর মাথার দাম নির্ধারণ করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। তবুও বাম রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে কখনো পিছপা হননি তিনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজশাহী জেল থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য এবং কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সংগঠক।
স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ ও ১৯৮০ সালে তিনি সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। বারবার নিষিদ্ধ ঘোষিত পার্টি পুনর্গঠনে এবং রাজনৈতিক চরমপন্থা ও সামরিক দমননীতি প্রতিহত করতে তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।
১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণি সিংহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সংগ্রামী জীবনের স্মরণে নেত্রকোণার দুর্গাপুরে ‘টংক স্মৃতিস্তম্ভ’ চত্বরে প্রতিবছর আয়োজিত হয় ‘কমরেড মণি মেলা’। এটি শুধু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, বরং শ্রেণিসংগ্রাম ও ন্যায়ের পথে চলার প্রতিশ্রুতি পুনর্বার উচ্চারণের মঞ্চ।
কমরেড মণি সিংহ আমাদের ইতিহাসের সেই অধ্যায়, যিনি রক্ত ও ঘামে গড়ে তুলেছিলেন বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের পথ। জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ।