বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫

| ১২ ভাদ্র ১৪৩২

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা : উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের প্রণোদনা

সমাজকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬:২৬, ১৬ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১৬:২৮, ১৬ আগস্ট ২০২৫

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা : উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের প্রণোদনা

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। ১৮৪৩ সালের ১৬ আগস্ট (১ ভাদ্র, ১৭৬৫ শক) ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসেবে এই সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায়। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রাহ্মধর্মের প্রচার ও তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ছিল এর মূল লক্ষ্য, তবে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল না কেবল ধর্মীয় আলোচনায়—এটি ছিল সমসাময়িক বাঙালি সমাজের বৌদ্ধিক জাগরণের অন্যতম অনুঘটক।

সম্পাদক ও লেখকবৃন্দ
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন বাঙালি সাহিত্য ও চিন্তার জগতে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা—দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজনারায়ণ বসু, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ। তাদের লেখায় বাংলা গদ্যের নতুন ধারা, যুক্তিনির্ভর আলোচনার ধারা, এবং আধুনিক চিন্তার বিস্তার ঘটে। পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক ও লেখকরা ছিলেন মূলত সংস্কারপন্থী, যারা বেদান্ত-প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার পাশাপাশি বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব ও দর্শন নিয়ে লিখতেন।

বিষয়বস্তু ও দৃষ্টিভঙ্গি
যদিও প্রাথমিকভাবে পত্রিকাটির লক্ষ্য ছিল বিশুদ্ধ ধর্মচর্চা, অক্ষয়কুমার দত্ত এর পরিসর বিস্তৃত করেন। তার সম্পাদনায় বিজ্ঞানভিত্তিক ও জড়বাদী প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে, যা বাংলা সংবাদপত্রের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাঙালিদের অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রস্তুতি, ও সামাজিক সংস্কারের আহ্বানও নিয়মিত স্থান পায়। এর ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ সম্ভব হয়—যারা পূর্বে বাংলা পত্রিকা পড়াকে তুচ্ছ করতেন।

পেপার কমিটি ও প্রকাশনার মান
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রবন্ধ নির্বাচন হতো একটি বিশেষ পেপার কমিটির মাধ্যমে। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, শ্রীধর ন্যায়রত্ন, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ, এবং অক্ষয়কুমার দত্ত। রামমোহনের পুত্র রাধাপ্রসাদ রায় পত্রিকার জন্য একটি মুদ্রণযন্ত্র দান করেছিলেন—যা প্রকাশনার মান উন্নত করে।

ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে ভূমিকা
পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার মূলত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। ঢাকার ব্রাহ্মসমাজ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ব্রজসুন্দর মিত্র এই পত্রিকার পাঠক ছিলেন, এবং এর প্রভাবেই তিনি ব্রাহ্মধর্মে অনুপ্রাণিত হন। উনিশ শতকের অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থায় পত্রিকাটি ছিল ব্রাহ্মসমাজের কার্যক্রমের এক প্রধান বাহক।

অস্তিত্ব ও অবসান
১৮৫৯ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা বিলুপ্ত হলে পত্রিকার দায়িত্ব চলে যায় কলকাতার ব্রাহ্মসমাজের হাতে। অক্ষয়কুমারের পর নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। অবশেষে ১৯৩২ সালে পত্রিকার প্রকাশনা স্থগিত হয়।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা কেবল একটি ধর্মীয় মুখপত্র ছিল না; এটি ছিল উনিশ শতকের বাঙালির বৌদ্ধিক পুনর্জাগরণের প্রতীক। বাংলা গদ্যের মানোন্নয়ন, আধুনিক চিন্তার প্রসার, বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সামাজিক সংস্কার—সবকিছুর সঙ্গেই এর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাসে এর স্থান তাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ: