গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনায় জাতিসংঘের সমর্থন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮:৩৫, ১৮ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১০:১৩, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ঘিরে দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংকট যেন আরেকবার বৈশ্বিক পরাশক্তির পালাবদলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এর মাঝেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দরজায় পৌঁছায়। আর সেই খসড়া প্রস্তাবই—জটিল আলোচনার পর—হঠাৎ করেই বেশিরভাগ সদস্য দেশের সমর্থন পেয়ে পাস হয়ে গেল।
মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যখন ভোটগ্রহণ হলো, তখন যেন পুরো বিশ্বের নজর আটকে ছিল সেই ডিজিটাল বোর্ডটির দিকে। ১৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে হাত তুলল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো এক জায়গায় দাঁড়াল। কোনো দেশ এর বিরোধিতা করল না। তবে দুই বৈশ্বিক পরাশক্তি—রাশিয়া ও চীন—ভোটদানে বিরত থেকে নিজেদের কূটনৈতিক দূরত্বটুকু বজায় রাখল।
এই সমর্থনের মধ্য দিয়েই জন্ম নিল এক নতুন আন্তর্জাতিক আলোচনা: গাজায় আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) পাঠানো কি আসলে সমাধানের পথে এগোনো, নাকি নতুন এক অভিভাবকত্বের সূচনা?
যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা: নিরাপত্তা, নিরস্ত্রীকরণ এবং নতুন নিয়ন্ত্রণ কাঠামো
ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে পরিকল্পনাটি সাজিয়েছে, সেখানে সবচেয়ে বড় উপাদান হলো গাজায় একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন করা—যারা বেসামরিক মানুষকে সুরক্ষা দেবে, মানবিক সাহায্য পৌঁছানো নিশ্চিত করবে এবং একই সঙ্গে হামাসসহ সব অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র সংগঠনের অস্ত্র স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করবে।
ওয়াশিংটন বলছে, কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে এই বাহিনীতে সেনা পাঠানোর আগ্রহ দেখিয়েছে, যদিও তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি—এটি হবে “নিরপেক্ষ, পেশাদার আন্তর্জাতিক বাহিনী”, যারা ইসরায়েল ও মিসরের সঙ্গে সুসমন্বিতভাবে কাজ করবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, গাজায় নতুন একটি পুনঃপ্রশিক্ষিত ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনী গঠন করা হবে, যা আর হামাসের অধীনে থাকবে না। এলাকাটিকে “সামরিকীকরণমুক্ত” করাই এ পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য।
হামাসের প্রত্যাখ্যান: ‘এটি আমাদের ওপর নতুন অভিভাবকত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে’
তবে গাজার নিয়ন্ত্রক শক্তি হামাস এই প্রস্তাবকে খুব স্পষ্ট ভাষায় ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে ঘোষণা করেছে। টেলিগ্রামে দেওয়া বিবৃতিতে তারা বলেছে—“এই পরিকল্পনা গাজায় আন্তর্জাতিক অভিভাবকত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে। এটি ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও প্রতিরোধের ইতিহাসকে অস্বীকার করে।”
হামাস মনে করে, আন্তর্জাতিক বাহিনীকে দিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা মূলত গাজাকে একটি দীর্ঘমেয়াদি নজরদারির অঞ্চলে পরিণত করবে।
তাদের আরও দাবি—এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মাইক ওয়াল্টজ বলেন,
“আমাদের লক্ষ্য খুব পরিষ্কার—গাজায় শান্তি, নিরাপত্তা এবং বেসামরিক মানুষের জীবন রক্ষার কাঠামো তৈরি করা। আইএসএফ-এর কাজ হবে সন্ত্রাসী অবকাঠামো ভেঙে ফেলা, ব্যবহৃত অস্ত্র অপসারণ করা এবং অঞ্চলটিকে নিরাপদ রাখা।”
তার মতে, এই পরিকল্পনাই দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা থেকে এগিয়ে যাওয়ার বাস্তবসম্মত পথ।
এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা?
গাজা—যে ভূমির ওপর বহু দশক ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর মানবিক বিপর্যয় জড়িত—সেখানকার ভবিষ্যৎ আবারও গভীর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
জাতিসংঘে এই প্রস্তাব পাস হওয়ায় আন্তর্জাতিক মহল বলছে—এটি হয়তো শান্তির পথে নতুন এক সম্ভাবনা, আবার কেউ কেউ দেখছেন—এটি নতুন এক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সূচনা, যার প্রতিক্রিয়া আরও বিস্তৃত হতে পারে।
আর গাজার মানুষ? তারা অপেক্ষা করছে—এই নতুন সিদ্ধান্ত তাদের অস্থির জীবনে আশা নিয়ে আসবে, নাকি আরও একটি বিভাজনের সূচনা করবে।
