রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

| ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

লন্ডনে হুমকিতে পড়বে টিউলিপের রাজনীতি?

হাবীব ইমন

প্রকাশ: ১০:১৫, ২ ডিসেম্বর ২০২৫

লন্ডনে হুমকিতে পড়বে টিউলিপের রাজনীতি?

ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–৪ এর সাম্প্রতিক রায় শুধু বাংলাদেশের আইন-আদালতের ইতিহাসে নয়, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনেও এক অনন্য উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক—শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনকারী এক মুখ—বাংলাদেশের একটি দুর্নীতি মামলায় অনুপস্থিতিতেই দুই বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন। ঘটনাটি একদিক থেকে আইনগত, অন্যদিকে কূটনৈতিক, আবার তৃতীয় মাত্রায় গভীর রাজনৈতিক সংকেতপূর্ণ।

টিউলিপ লেবার পার্টির এমপি, লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেটের নির্বাচিত প্রতিনিধি। ব্রিটিশ রাজনীতিতে বহুসংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ। কিন্তু ঢাকার আদালতের রায়ে তাকে অন্যদের সঙ্গে সাজা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভূতপূর্ব নজর কাড়ল। কারণ কোনো বিদেশি সংসদ সদস্যকে তার নিজ দেশের বাইরে অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা খুব বিরল। তার ওপর তিনি আবার ইউকে পার্লামেন্টের বর্তমান সদস্য—এমন অবস্থায় বাংলাদেশি আদালতের সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক, আইনি মানদণ্ড এবং আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।

রায়ে বলা হয়, টিউলিপ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ফোনকল ও বার্তা পাঠিয়ে তার মা শেখ রেহানার পক্ষে ‘অবৈধ প্রভাব’ সৃষ্টি করেছেন এবং ঢাকায় এসে প্লট বরাদ্দ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। অথচ গার্ডিয়ানসহ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম একাধিক প্রশ্ন তুলেছে—সেসব ‘যোগাযোগের প্রমাণ’ কোথায়? তারা জানায়, আদালতে যে প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে তার বেশিরভাগই এসেছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দুই কর্মচারীর মৌখিক সাক্ষ্য থেকে। কোনো লিখিত নথি বা ডিজিটাল ট্রেস আদালতে দেখানো হয়নি। এ কারণে গার্ডিয়ান তাদের প্রতিবেদনে বিচারকে “unverifiable claims–based” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

টিউলিপ নিজেও সরাসরি বলেছেন—তিনি মামলার বিষয়ে কখনো অবগতই ছিলেন না। তার ভাষায়, “আমাকে আইনজীবী নিয়োগের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। অভিযোগের বিবরণও জানানো হয়নি। পুরো বিচার ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।” তিনি আরও দাবি করেছেন, যে ‘বাংলাদেশি পাসপোর্ট’ দেখানো হয়েছে তা জাল, কারণ তিনি শৈশবের পর কখনো বাংলাদেশি নাগরিকত্ব বজায় রাখেননি।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুদক জানিয়েছে, তারা জানতে চাওয়ার মতো সব ঠিকানায় নোটিশ পাঠিয়েছে—কিন্তু বিষয়টি কতটা বাস্তবে পৌঁছেছে, তা নিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রশ্ন থামছে না। কারণ ব্রিটিশ আইনে কোনো অভিযোগ সম্পর্কে ব্যক্তিকে আগেই বিস্তারিত জানানো বাধ্যতামূলক, আর অনুপস্থিতিতে বিচারকে আদালত সাধারণত সহজভাবে মেনে নেয় না। লেবার পার্টিও স্পষ্ট জানিয়েছে—ন্যায়সংগত শুনানি ছাড়া এ রায়কে তারা স্বীকৃতি দেবে না। এমনকি কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক আইনমন্ত্রী এবং ব্রিটেনের একদল শীর্ষ আইনজীবী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলেছেন—বিচার ছিল “artificial, staged and unfair।” তারা অভিযোগ করেছেন, টিউলিপের মৌলিক অধিকারের কোনো নিশ্চয়তাই রক্ষা করা হয়নি।

ঢাকার আদালতের বক্তব্য—আসামি হাজির না হলে বাংলাদেশ আইনের অধীনে তিনি পূর্ণ বিচারিক সুবিধা পাবেন না। মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ নয়, তাই আত্মসমর্পণ ছাড়া আইনজীবীও রাখা যায় না। আইনি যুক্তি হিসেবে এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা হলে তার মেইল ঠিকানা, বাসস্থান, কনস্যুলার চ্যানেল, অথবা আন্তর্জাতিক নোটিফিকেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে তথ্য পৌঁছে দেওয়া উচিত—এটাই প্রচলিত রীতি। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা জিজ্ঞাসা করছেন: টিউলিপ কি আদৌ যথাযথ নোটিশ পেয়েছিলেন? তিনি কি জানতেন কোথায় এবং কীভাবে আত্মসমর্পণ বা আইনি প্রতিনিধিত্ব করা যাবে? এই অস্পষ্টতা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে, এই রায় এমন এক সময়ে এসেছে যখন অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে বৃহৎ অভিযান চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে আরেকটি দুর্নীতি মামলায় ২১ বছরের দণ্ড পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহলে এ ধরনের পদক্ষেপকে কেউ কেউ বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি ভাঙার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে। আবার কেউ কেউ বলছে, এটি রাজনৈতিক পুনর্গঠনের এক নতুন অধ্যায়, যেখানে অতীত ক্ষমতাধারীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চলছে। কিন্তু এই কঠোরতার মধ্যেই প্রশ্ন উঠে—শুদ্ধি অভিযান কি বিচারিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বিচারব্যবস্থা কি আন্তর্জাতিক মান লঙ্ঘন করছে?

এই রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় টিউলিপ বলেছেন, তিনি আসলে তার খালা শেখ হাসিনা ও মুহাম্মদ ইউনূসের দীর্ঘ রাজনৈতিক বিরোধের শিকার। এই বক্তব্যটি যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক মহলে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে। কারণ বিদেশি সরকার তার নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে বিদেশি নাগরিকের ওপর চাপিয়ে দিলে তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বড় প্রশ্ন সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ সংসদের কিছু সদস্য ইতিমধ্যে এই রায়কে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার “external spillover effect” হিসেবে দেখছেন।

অন্যদিকে বাস্তবিক দিক থেকে বিচার কার্যকর হওয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে কোনো প্রত্যার্পণ চুক্তি নেই। ফলে টিউলিপকে বাংলাদেশে আনা যাবে না। তবে আন্তর্জাতিক ভ্রমণে তিনি কিছু সমস্যায় পড়তে পারেন—বিশেষ করে যেসব দেশ আদালতের দণ্ডকে প্রাথমিক ইমিগ্রেশন ঝুঁকি হিসেবে ধরে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে তার বাংলাদেশ ভ্রমণে—যা এখন কার্যত অসম্ভব।

তবে কি এই রায় লন্ডনে টিউলিপের রাজনীতিকে সরাসরি বিপদে ফেলবে? ব্রিটিশ রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিষয়টি এত সহজ নয়। হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেটের ভোটারদের বড় অংশ দক্ষিণ এশীয়; তারা বাংলাদেশি রাজনৈতিক সংঘাতকে সাধারণত লন্ডনের প্রেক্ষাপটে তুলে দেখেন না। লেবার পার্টি তার পাশে রয়েছে—এটি তার জন্য বড় সুবিধা। কিন্তু বিরোধীরা এই রায়কে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে নৈতিক প্রশ্ন তুলবে, তাকে ‘controversial MP’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা হবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডার্ডস কমিশন চাইলে আলাদা তদন্ত খুলতে পারে—যদিও এখনো সে রকম ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

সব মিলিয়ে, রায়ের রাজনৈতিক অভিঘাত দ্বিমুখী। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এটি দুর্নীতিবিরোধী কঠোরতার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটি ন্যায়বিচারের মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করছে—স্বাধীন বিচারব্যবস্থা কি ন্যূনতম আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করেছে? রাজনৈতিক আসামিদের অনুপস্থিতিতে বিচার কি বৈধতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ?

বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য এটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান অবশ্যই জরুরি; কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায়সংগততা আন্তর্জাতিক মানে নিশ্চিত না হলে রাজনৈতিকভাবে যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে তা প্রায়ই উল্টো ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। আর টিউলিপের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ? আপাতত হুমকিতে পড়েছে বলা যাবে না, কিন্তু তার সামনে লেবার পার্টির ব্যস্ত লন্ডন রাজনীতিতে এখন নতুন এক সংকটের ছায়া নেমে এসেছে—যা তিনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না।

বাংলাদেশ–যুক্তরাজ্য সম্পর্কের পরবর্তী ধাপ, এবং বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা এখন এই রায়ের উপরই ঝুলে আছে—এটাই এই মামলার সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব।

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

৫ বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৪২%
৮-১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল
জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনে ইসি প্রস্তুত, প্রধান উপদেষ্টাকে সিই
নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থ, পেশীশক্তি ও ধর্মের অপব্যবহার বিষয়ে অঙ্গীকার চায় টিআইবি
সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ‘ব্যর্থ’: টিআইবি
বাড়ল ভোজ্যতেলের দাম
কৃষি কর্মকর্তাদেরও লটারির মাধ্যমে পদায়ন: কৃষি উপদেষ্টা
আরও ১০০ কোল্ড স্টোরেজ: কৃষি উপদেষ্টা
ভোটের দায়িত্ব পাচ্ছেন না বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তারা
১৯৭১ সালেই মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড দেখেছে : তারেক রহমান
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসিসহ চার নির্বাচন কমিশনারের বৈঠক
রোজা–পূজা নিয়ে মন্তব্য : জামায়াত প্রার্থী শিশির মনিরের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ : পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান
নতুন জোটের ঘোষণা দিল এনসিপি
রাজবাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংরক্ষিত কবরস্থানে নাশকতা
প্রেস সচিবের ফেসবুক পোস্ট; ৩ কয়লাখনি থেকে কয়লা না তোলা ভুল ছিল
আজ নোয়াখালী মুক্ত দিবস
শিক্ষা ভবনের সামনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু
বিটিআরসির সামনে মোবাইল ব্যবসায়ীদের সড়ক অবরোধ