প্রাণীর প্রতি মানুষের দায় ও দয়া
মাইসারা জান্নাত
প্রকাশ: ০০:২৫, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
প্রাণীর প্রতি করুণা ও ভালোবাসা মানব হৃদয়ের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার। ইসলাম পৃথিবীর বুকে বিচরণশীল প্রতিটি প্রাণীর জন্য এক মহৎ জীবনবোধের বার্তা দিয়েছে। তা হলো, ন্যায় ও দয়ার বার্তা। দিগন্তে ডানা মেলে উড়া পাখি থেকে শুরু করে ভূমিতে বিচরণ করা কুকুরও আমাদের মতোই এক একটি স্বতন্ত্র জাতি। তাদের প্রতি মানুষের দায় আছে, আছে দয়া প্রদর্শনের হুকুম।
সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদীতে আটটি কুকুরছানাকে বস্তাবন্দী করে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যার যে নির্মম ও নিষ্ঠুর কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে, তা সত্যিই খুব বেদনাদায়ক। মা কুকুরটির অসহায়ত্ব সবাইকে খুব ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। মানুষ কিভাবে পারে এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে? মানুষের ভিতর কি সামান্যতম ধর্মীয় শিক্ষা নেই?
পিপাসার্ত প্রাণীর মুখে এক ফোঁটা পানি তুলে দেওয়া বা অসহায় প্রাণীর প্রতি মমতা দেখানো আল্লাহর কাছে খুব প্রিয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষায় আমরা দেখি, প্রাণীর প্রতি সামান্য দয়াও জাহান্নাম থেকে মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে, আবার সামান্য নিষ্ঠুরতাও জাহান্নামের কারণ হতে পারে।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে চলমান যেকোনো প্রাণী এবং ডানা মেলে উড়ন্ত যেকোনো পাখি, সবাই তোমাদের মতো একেকটি জাতি। আমি কিতাবে কোনো বিষয়ই বাদ রাখিনি। অতঃপর সবাইকে তাদের রবের কাছে সমবেত করা হবে।’ (সুরা আনআম ৩৮)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, প্রতিটি প্রাণী আল্লাহর সৃষ্টি এবং স্বতন্ত্র জাতি। তাদের অস্তিত্ব ও অধিকার সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞান ও হেকমত রয়েছে এবং কেয়ামতের দিন প্রাণীরাও তাদের অধিকার দাবি করবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা দয়া করে, দয়াময় আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা পৃথিবীর বাসিন্দাদের প্রতি দয়া করো, তাহলে আসমানের অধিপতি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ)
এখানে ‘পৃথিবীর বাসিন্দা’ বলতে মানুষসহ সকল প্রাণীকূল বোঝানো হয়েছে। এটি নির্দেশ করে, প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি ও দয়া দেখানো ঈমানের অংশ।
প্রাণীর প্রতি সামান্য দয়া আল্লাহর নিকট মহান পুরস্কার বয়ে আনে। হাদিসে বর্ণিত আছে, এক নারী কূপের পাশে তৃষ্ণায় হাঁপাতে থাকা এক কুকুর দেখে তার মোজা ব্যবহার করে পানি খাওয়ান। এ কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ বুখারি)
অপর হাদিসে বর্ণিত আছে, এক নারী একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল এবং খাবারও দেয়নি। বিড়াল মারা গেলে সেই নারীর জন্য আল্লাহ জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারণ করে দেন। (সহিহ বুখারি)
বিনা কারণে প্রাণী হত্যা সম্পূর্ণ হারাম। খেলাধুলা বা বিনোদনের জন্য প্রাণী হত্যা, নির্যাতন, আগুনে পোড়ানো বা অঙ্গহানি করা নিষিদ্ধ।
সীমিতভাবে বৈধ হত্যার ক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে। খাদ্যের জন্য হালাল পশু শরিয়তসম্মতভাবে জবাই করা যায়। এছাড়া প্রাণরক্ষার জন্য পাগলা কুকুর, বিষধর সাপ বা রোগবাহিত প্রাণীকে সীমিতভাবে হত্যা করা যায়। ফসল রক্ষার প্রয়োজনে ক্ষতিকর প্রাণী যেমন ইঁদুর বা পঙ্গপালও সীমিতভাবে মারা যেতে পারে। তবে সর্বদা ন্যূনতম কষ্টের পদ্ধতি বেছে নিতে হবে এবং বিকল্প থাকলে হত্যা করা যাবে না।
প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শন করা এবং তাদের ন্যায্য যত্ন নেওয়া ইসলামি নির্দেশনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ক্ষুধার্ত বা তৃষ্ণার্ত প্রাণীকে সাহায্য করা, আহত বা অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসা করা, প্রাণীর সামর্থ্য অনুযায়ী বোঝা দেওয়া এবং জবাইয়ের সময় দয়া ও উত্তম পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
ইসলামের শিক্ষা হলো, প্রতিটি প্রাণীর জীবন মর্যাদাপূর্ণ, প্রাণীর প্রতি দয়া ঈমানের অংশ। হত্যা শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনে ও শরিয়তের সীমারেখায় অনুমোদিত। প্রাণী রক্ষা কেবল আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, এটি আমাদের ঈমানি দায়িত্ব ও নৈতিক কর্তব্য।
