বাংলাদেশিদের নব্য ইতিহাস বিতর্ক
প্রকাশ: ১৯:০৪, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
মিরাজুল ইসলাম
সম্প্রতি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা এবং চর্বণের নতুন ধারা চালু হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্বৈরতন্ত্র তথা শেখ হাসিনার ওপর গোস্বাবশত জামায়াতে ইসলামী ঘরানার জেন-জি চক্রের নেতা-নেত্রীদের কেউ কেউ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা এবং বিজয় দিবসের মাহাত্ম্যকে ‘আন্ডারমাইন’, অর্থাৎ খর্বাকার করতে চাচ্ছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসকে এককভাবে ‘ভারতীয় অবদান’ দাবি করার পাশাপাশি আমাদের প্রকৃত মুক্তির সংগ্রামের উৎস ১৯৪৭ সাল দাবি করার যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ এমনও দাবি করছেন ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগ্রামে তৎকালীন ভারতীয় সরকার কেন এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে সাহায্য করেছিল তা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। অবশ্য যারা ষাটের দশকে এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশদ জানেন না, এই জাতীয় বিতর্কে তাদেরই উৎসাহ বেশি। সেই আলাপে কালক্ষেপণ না করে আপাতত আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাই বাংলাদেশি জাতিসত্তার মূল উৎসজাত সময়কাল কোনটি তার সঠিক ইতিহাস বুঝতে। বুঝলাম এখন আওয়ামী শাসন নেই। সুতরাং একাত্তরে বাংলাদেশের জন্মলাভের ক্রেডিট ভাগাভাগি করতে অনেকগুলো পক্ষ এই মুহূর্তে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। বিশেষ করে ইসলামী দলগুলো এই নতুন বয়ানে বেশ সক্রিয়।
একাত্তরের পর থেকে আওয়ামী লীগ এককভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের দাবিদার ছিল। কারণ ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে তারাই ছিল প্রধান এবং একমাত্র রাজনৈতিক দল। পরবর্তী সময়ে দলটি কীভাবে আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবর্তিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে কলুষিত হলো সেটা অন্য আলাপ। এরপর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সূত্রে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে অন্যতম দাবিদার হয়ে উঠল।
বিশেষ করে শেখ মুজিবের পাশাপাশি স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠিত করবার অবস্থান ও নীতি থেকে দলটি এক বিন্দু বিচ্যুত হয়নি। এভাবে আওয়ামী লীগের সাথে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে অন্যতম দাবিদার হবার প্রধানতম আদর্শিক এবং চেতনাগত রাজনৈতিক লড়াই শুরু হলো বিএনপির।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্টেকহোল্ডার হিসেবে এই দুই প্রধান দলের ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতার’ মধ্যে তৃতীয় কোনো দল অংশ নেবার প্রশ্নই ছিল না। একই সাথে বামফ্রন্ট কিংবা বাসদ-জাসদ দলগুলো আওয়ামী-বিএনপির ছায়ায় সহযোগী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হিসেবে সোচ্চার ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অংশীদারত্বে প্রথমবারের মতো ভাগীদার হিসেবে দাবি তুলছে জামায়াতে ইসলামী।
ইতিহাসের পাতায় যারা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। অথচ বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্ন তথ্য-বয়ানে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল আলাপটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। খুব ভালো। ইতিহাস এভাবেই বদলায়, পাল্টায়।কারণ মানুষের হাতেই ইতিহাস রচিত হয়, দিক বদল হয় সংজ্ঞা এবং ঘটনার।
এই প্রসঙ্গে ইতিহাসবেত্তা অশীন দাশগুপ্তের কথা মনে পড়ছে। অশীন দাশগুপ্ত ইতিহাসকে কেবল রাজনীতি বা যুদ্ধের ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, বৃহত্তর মানব-ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখেছেন। যার মধ্যে সংস্কৃতি, সমাজ এবং মানুষের জীবনধারার অন্যান্য দিকগুলোও অন্তর্ভুক্ত। এই ব্যাখ্যার ভিন্নতর অপব্যাখ্যায় সম্ভবত জামায়াতে ইসলামীর বুদ্ধিজীবীগণ বর্তমানে ব্যস্ত। তারা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি বৃহত্তর পরিসর থেকে দেখতে গিয়ে বাংলাদেশের বাংলাদেশি এবং বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসকে তালগোল পাকিয়ে কেউ তাত্ত্বিকভাবে ১৯৪৭ কিংবা কেউ অতি আবেগে ১৭৫৭ সালে ফিরে যাচ্ছেন। তা ফিরতেই পারেন।
বঙ্গীয় ভূ-রাজনৈতিক-সামাজিক-নৃতাত্ত্বিক বলয়ের আলোকে বৃহত্তর বাঙালি থেকে বাংলাদেশের বাংলাদেশি হবার যে ইতিহাস তার উৎস সেই অর্থে সুপ্রাচীন। সেই হিসেবে আমি নিজে ফিরে যাব আজ থেকে তিন হাজার সাতশো বছর আগে। যখন উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলের সাত নদীর অববাহিকায় বৈদিক সভ্যতার লোকজন বাস করতেন।
বলা হয়, প্রাচীনতম ধর্মের সূত্রধর হিসেবে তারাই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘ঋগ্বেদ’-এর স্রষ্টা। যাযাবর জীবন ছিল তাদের। স্থায়ী ঘরবাড়ি নির্মাণে কেন উৎসাহ ছিল না তা নিয়ে অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে। তাদের না ছিল শহর, না ছিল দেবালয়। কাঠের ফ্রেম দিয়ে বাঁশ বা খড়ের চালায় মাটির চারকোনা অস্থায়ী ঘর বানাতেন। ১০২৮টি ছন্দোবদ্ধ পদ্য আছে ঋগ্বেদে। সেগুলো ভাগ করা হয়েছে বিভিন্ন অধ্যায়ে। দ্রাবিড়-আদি সংস্কৃত- ইন্দো পারসিক-অস্ট্রো এশিয়াটিক (মুণ্ডা)-তামিল নানা ভাষায় এর প্রকাশ ছিল। সেই যুগের সমাজের শ্রেণি বিন্যাসের (আর্য-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র) নানা পেশার মানুষের সুখ-দুখ, উপকথা, নীতিকথা ইত্যাদি নিয়ে এই ‘অলিখিত’ গ্রন্থ। মুখে মুখে বংশ পরম্পরায় ঋগ্বেদের মন্ত্র-মণ্ডলা হাজার বছর পেরিয়ে এখনো অবিকৃত রয়েছে বলে দাবি করা হয়। এটি ছিল ‘চলমান ধর্ম’ দর্শন।
অগ্নি-বরুণ-ইন্দ্র ত্রয়ীকে দেবতা-স্রষ্টা-ভগবানরূপে পরিচয় করিয়ে দেবার আনুষ্ঠানিক সূচনাটা তখন হতে শুরু। সেখানেই প্রথম জানা যায় মর্ত্যের নারী অপালা তার প্রেম ও দেহ নিবেদন করেছেন দেবরাজ ইন্দ্রকে। গ্রিক পুরাণে একইভাবে জিউসের সাথে ইন্দ্রের স্বভাব-চরিত্রের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বৈদিক গ্রন্থে উল্লেখিত অদিতি নামের আরেক ঐশ্বরিক ক্ষমতাবান নারীর সাথে গ্রেকো-রোমান দেবী ভেনাসের মিল মোটেও কাকতাল নয়।
কয়েক হাজার বছর পরে বহু ধর্ম-বর্ণে বিভক্ত হয়ে সমাজব্যবস্থা পাল বংশ-সেন আমল পেরিয়ে সুলতানি আমল-মুঘল শাসনের অবসানের পর ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে যখন বাঙালি জাতির ঠিকুজি খুঁজতে চায়, তখন কার স্বার্থে বৈদিক যুগকে অস্বীকার করা তা গভীরভাবে ভাবা উচিত।
সেই ধারা-প্রতিধারায় বাঙালি থেকে বাংলাদেশি জাতিতে প্রতিস্থাপনের ইতিহাস সুদূর বৈদিক যুগ থেকে শুরু করলে দোষ কোথায়?
হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্তার অনুসন্ধানে ১৯৪৭ কিংবা ১৭৫৭ তো কেবল একটা সংখ্যা মাত্র। বৈদিক যুগ এখন নেই। আছে বৈশ্বিক যুগ। বয়ান তৈরির রাজনীতিতে নানা মতের চর্চায় সবাই যার যার অবস্থানে সর্বেসর্বা। মূলত অজ্ঞ ধর্মান্ধতা এবং নতুন যুগের অরাজকতার সূচনা করতে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস বিকৃতির চর্চা যারা করতে চাচ্ছে তাদের উদ্বেগ যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিশোধমূলক!
লেখক: চিকিৎসক, শিল্প-শিক্ষা গবেষক (ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র)
* মতামত লেখকের নিজস্ব
