বাংলাদেশ রিপাবলিক: বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব প্রসঙ্গে
প্রকাশ: ১৭:০৬, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৮:০৪, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
মাসুদ রানা
বিপ্লবে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র নির্ধারণের অধিকার পার্লামেন্টের নেই। এটি গণতন্ত্রের বিষয় নয় এবং এখানে গণতন্ত্র প্রযোজ্য নয়। গণতন্ত্রের নামে-অর্থাৎ পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, যদি রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তন করা হয়, সেটি হবে প্রতিবিপ্লব; প্রতিবিপ্লবের নানা রূপ থাকতে পারে।
বিপ্লবে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের প্রকৃত রক্ষাকর্তা বা কাস্টোডিয়ান হলেন রাষ্ট্র-বিপ্লবের বিপ্লবীরা। বাংলাদেশ রিপাবলিক রক্ষার ক্ষেত্রে কাস্টোডিয়ান হওয়ার কথা ছিল মুক্তিফৌজ বা মুক্তিবাহিনী।
দুর্ভাগ্যবশত বিপ্লবে অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যার নামে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেই প্রেরণাদায়ক নেতা, শেখ মুজিবুর রহমান, পাকিস্তানের বন্দিত্ব থেকে ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে, বিজয়ী মুক্তিবাহিনীকে জাতীয় সেনবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিবর্তে, ভেঙে দিলেন। আর সেদিনই, বস্তুত বাংলাদেশ রিপাবলিকের জন্মগত প্রতিরোধব্যবস্থায় মৌলিক দুর্বলতা বাসা বাঁধল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভারত বা পাকিস্তানের মতো ব্রিটিশ-রাজ বা অন্য কোনো রাজা-মহারাজার অনুমোদনে সৃষ্ট হয়নি। এই রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল নির্বিশেষে এদেশের জনগণের সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। তাই, এই রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের পরিবর্তন প্রয়াসী যে-কোনো প্রতিবিপ্লবকে ১৯৭১ সালের বিপ্লবের দীর্ঘজীবীতা দিয়ে রুখতে হবে।
এটি ঠিক যে, মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব নেই; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের বংশধরেরা আছেন, যারা এখনও সেই বিপ্লবের তিন প্রতিশ্রুতির—সাম্য, মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের—চেতনা লালন করেন। এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দেশের কোটি-কোটি মানুষ আছেন।
১৯৭১ সালের বিপ্লবে প্রতিশ্রুত ‘সাম্য’ বলতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-অঞ্চল নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার; ‘মর্যাদা’ বলতে জাতিগতভাবে সমগ্র জাতির এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি ব্যক্তির মনুষ্য মর্যাদার স্বীকৃতি ও সুরক্ষা; এবং ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ বলতে আইনের শাসন এবং প্রতিটি মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষাসহ সকল মৌলিক মানবিক অধিকারের প্রতিষ্ঠা বুঝায়, যা ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রের চার মৌল-নীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র নামে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
আজ বাংলাদেশ রিপাবলিক তার জন্মের তিন প্রতিশ্রুতি তথা রাষ্ট্রীয় চার মৌল-নীতি থেকে অনেক দূর সরে এসেছে। কারণ, ১৯৭১ সালের মার্চে রাষ্ট্রবিপ্লবের পর ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাকশালী প্রতিবিপ্লবসহ একই বছরের আগস্টে একাধিক সামরিক প্রতিবিপ্লবসহ নানা প্রকারের সামরিক ও অসামরিক প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়ে বাংলাদেশ রিপাবলিকটা ভেতর থেকে খুবই দুর্বল করে দিয়েছে।
বর্তমানে প্রতিবিপ্লবীদের বিভিন্ন দল প্রধানত দু’জোট বেঁধে রাষ্ট্র-ক্ষমতা চিরদিনের জন্যে ধরে রাখা বনাম কেড়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। এই প্রতিযোগিতার ফল যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ রিপাবলিক সম্পূর্ণরূপে তার মৌলিক চরিত্র হারাবে।
এই পরিস্থিতিতে যারা বাঙালি জাতির ১৯৭১ সালের অসামান্য অর্জনটুকু রক্ষা করতে চান, তাদেরকে প্রচলিত চিন্তার বৃত্ত ও আদর্শ থেকে বেরিয়ে এসে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে বিপ্লব ও রাষ্ট্র রক্ষার পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
লন্ডন, ইংল্যান্ড
* মতামত লেখকের নিজস্ব
