এখনই গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা প্রমাণের শ্রেষ্ঠ সময়
প্রকাশ: ২২:১৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২৫
নাদিম মাহমুদ
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতায় দেশের শৃঙ্খলায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ফলশ্রুতিতে মানুষের কণ্ঠস্বর ধারণ করার জন্য একমাত্র শক্তি দেশের গণমাধ্যম। যদিও শাসকগোষ্ঠীরা সব সময় এই মাধ্যমটিকে কুক্ষিগত করার চেষ্টায় থাকে, এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে সেই প্রভাব রয়েছে, তবে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা প্রমাণের শ্রেষ্ঠ সময় বলে আমি মনে করি।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের গণমাধ্যম দখলের যে হিড়িক পড়েছিল, তার ফলে দেশের হাতে গোনা কয়েকটি গণমাধ্যম ব্যতীত অধিকাংশ সেই আগের শাসকতুষ্টির সুরে কথা বলার চেষ্টা করছে। এখনো দেশের গণমাধ্যমগুলো সরকারের আজ্ঞাবহ কিংবা সেলফ সেন্সরশিপে চলার ভঙ্গিমা চোখে পড়ার মতো বিষয়।
এই শিকল থেকে বের হওয়ার জন্য গণমাধ্যমগুলোকে অবশ্যই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেশে ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারকগুলোতে যেভাবে আঘাত হচ্ছে, ক্রমাগত মিথ্যাচার চলছে তাতে নতুন প্রজন্মের বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকছে। দেশের কোর জায়গায় আঘাতের পরও গণমাধ্যমগুলোর দায়সারা ভাব আমাদের ব্যথিত করেছে। এবারও হাতে গোনা ২/১টি পত্রিকা ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাসভর যে সংবাদ পরিবেশন করে, তা থেকে পিছিয়ে আছে। ইতিহাসের নির্যাস জানাতে তারা কুণ্ঠাবোধ করছে অথবা এড়িয়ে যাচ্ছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে টেলিভিশন টকশোতে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু নিয়ে ক্রমাগত মিথ্যাচার করা হচ্ছে। যুক্তির আড়ালে কুযুক্তি দিয়ে ‘একাত্তর’ নিয়ে নয়া বয়ান তৈরির পাঁয়তারা হচ্ছে। এই ধারায় যোগ দিয়েছে সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠানও। মুক্তিযুদ্ধ যে এই দেশের শ্রেষ্ঠ অর্জন তাকে ঢাকবার জন্য একটি গোষ্ঠী স্পষ্ট করে বললে একাত্তরের পরাজিত শক্তি নানাভাবে গণমাধ্যমগুলোতে ‘অ্যাটেনশন’ পাচ্ছে। আর এই সুযোগে নিজেদের মধ্যে পুষে থাকা ক্ষোভ, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পূর্বপুরুষদের বিষোদগার উগরে দিচ্ছে। ফলে দেশে নতুন করে পোলারাইজেশন হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
এইভাবে চলতে থাকলে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। বিতর্কে তৈরি করার উদ্দেশ্যে কেউ যখন গণমাধ্যমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তখন আমাদের গণমাধ্যমগুলোর উচিত হবে ‘সমন্বিতভাবে’ অবস্থান নেওয়া। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করা ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকলে থাকবে, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত, ডকুমেন্টেড বিষয়ে কেবল মিথ্যাচার করলে গণমাধ্যমের উচিত হবে সেই অ্যামপ্লিফিকেশন বন্ধ করা। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ করা না গেলে এই গোষ্ঠী আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে ফেলবে।
পাকিস্তানের হায়েনাদের বিরুদ্ধে এই দেশের ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ উৎসর্গ করেছে, মা-বোন ধর্ষিত হয়েছে; নয় মাস যুদ্ধ হয়েছে, শেখ মুজিব এই দেশের স্থপতি এই কথাগুলোর বাহিরে কোন ইফ, বাট, নট চলবে না। এই দেশে থাকতে হলে, রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধকে মেনে, শেখ মুজিবুর রহমানকে, তাজউদ্দিনদের, জিয়াউর রহমানদের মেনেই রাজনীতি করতে হবে। কে স্বীকার করল, কে অস্বীকার করল, তাতে কোন কিছু আসে যায় না, তবে এই শক্তিগুলো যেন গণমাধ্যমের সুবিধা নিয়ে অপপ্রচার করতে না পারে তার দায়িত্ব অবশ্যই গণমাধ্যমের রয়েছে।
আসুন আপনারা সিদ্ধান্ত নিন, আগামী দিনের কোন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খবরাখবর বেশি করে প্রচার করুন, রাজাকার-আলবদর-আল শামসের পরিচয় করিয়ে দিন নতুন প্রজন্মের কাছে। পাকিস্তানের হায়েনাদের নৃশংসতার খবরগুলো জানুক তারা। ঘৃণা করা নয়, বরং সত্যটা জেনে নিজ দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা জন্মাক। শকুনদের দৃষ্টি থেকে বাংলাদেশকে অবশ্যই আমাদের রক্ষা করতে হবে। এখানে নানা ধর্মের, নানা মতের মানুষ বসবাস করবে, কিন্তু দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে আঘাত আসলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করার কাজটি অবশ্যই গণমাধ্যমের কাঁধে রয়েছে। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আসুন যারাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক করছে, তাদেরকে আপনার গণমাধ্যমে সুযোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকি। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই সংকটকে মোকাবিলা করি।
লেখক: গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
nadim.ru@gmail.com
* মতামত লেখকের নিজস্ব
