পালাগানের লড়াই ও স্রষ্টার কাছে ভক্তের অনুযোগ!

আমরা সিনেমায় দেখি ভিলেন মিশা সওদাগর ধর্ষণ করেন, খুন করেন। কিন্তু এর জন্য বাস্তবে উনাকে কোনো ধর্ষণ বা খুনের মামলা খেতে হয় না। কারণ ওটা সিনেমা। সিনেমায় ভিলেনের এন্টাগনিস্ট ক্যারেক্টার হিসেবে থাকে একজন নায়ক। নায়ক ও ভিলেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়। শেষে দেখানো হয় ধর্ষণ ও অন্যান্য খারাপ কাজের জন্য ভিলেন শাস্তি পাচ্ছে। নায়কের জয় হয়েছে।

পুরো বিষয়টা আমাদের কাছে বিনোদন এবং এক ধরনের শিক্ষাও বটে। আমরা যারা বুদ্ধিমান মানুষ তারা রাগ করে ভিলেনকে মেরে ফেলতে যাই না। চাইও না। আমরা জানি ওটা একটা সাজানো গল্প। তবে কিছু কম বুদ্ধির অতি আবেগী মানুষ ভিলেনের ওপর রাগ করে শুনেছি টিভি ভেঙে ফেলেন। স্বনামধন্য ভিলেন রাজকে নাকি একবার এফডিসির সামনে কিল-ঘুষি মেরে রক্তাক্ত করেছিলেন এক দর্শক। এগুলো আমাদের কাছে আবেগী মানুষের নির্বুদ্ধিতা, ক্ষেত্রবিশেষে অভিনেতার সাফল্য বলেই গণ্য হয়।

কবিগান বা পালাগানে দুইটি পক্ষ থাকে। জীব ও পরমের পালায় এক পক্ষ থাকে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিভাবে সিক্ত। আরেক পক্ষ অবিশ্বাসী অথবা সন্দেহবাদী। নায়ক ও ভিলেনের মতো একে অন্যের সাথে দ্বৈরথে লিপ্ত হয়। বহু তর্কবিতর্ক, বাহাস শেষে দুই পক্ষ এক হয়ে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে পালা সাঙ্গ করে।

কবিগানের লড়াই যারা করে তাদের একটা বড় অংশের দুর্বল দিক হলো খিস্তি-খেউড়, অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ, ব্যক্তিগত আক্রমণ। সেই আঠারো শতক থেকেই কবিগানের এই অশ্লীলতা নিয়ে নাগরিক পরিশীলিত মানুষ বিব্রত। সেই ভোলা ময়রা, হরু ঠাকুর, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিদের আমল থেকে শুরু করে হালের আবুল সরকার, শাহ আলম সরকার পর্যন্ত কমবেশি এই দোষে দুষ্ট।

তবে কবি গানের অনেক মহারথী ছিলেন যারা অশ্লীলতা থেকে অনেক দূরে থেকে তাদের সৃজনশীলতা ও দর্শন প্রকাশ করেছেন। গণমানুষকে বিনোদনও দিয়েছেন। কবিয়াল বিজয় সরকার, উকিল মুন্সী এদের অন্যতম। এইসব ভালো-মন্দের ভেতর দিয়েই দুইশ বছর পার করছে লোক বাংলার কবিগান, পালাগান, বিচার গান, মালজোড়া গান। আমাদের লোকজ দার্শনিকরা তাদের গভীর চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে আমাদের বোধের জগতকে নাড়া দিয়ে গেছেন। ভাব সাগরে ডুবিয়েছেন। আনন্দ দিয়েছেন। ভক্তি ও ভাবে অশ্রুসিক্ত করেছেন।

কবি আল্লামা ইকবালের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো শিকওয়া জওয়াবে শিকওয়া। শিকওয়া মানে অভিযোগ। জওয়াবে শিকওয়া মানে অভিযোগের জবাব। এখানে কবি একবার সন্দিগ্ধ মন নিয়ে অভিযোগ করেছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। পরক্ষণে জবাব দিয়েছেন সেই অভিযোগের। বিশ্ব সাহিত্যের কাছে কবি ইকবালের এই সওয়াল জবাব একটি অভিনব, আকর্ষণীয় কাব্যধারা। আমাদের কবি গানের ইতিহাসে তা দুইশ বছরের পুরনো।

কাজী নজরুল ইসলাম তার এক গানে আল্লাহকে প্রশ্ন করেছেন—বিচার যদি করবে কেন রহমান নাম নিলে। ওই নামের গুনে তরে যাব, কেন এই জ্ঞান দিলে? স্রষ্টার কাছে ভক্তের এই অনুযোগ যেন ভক্তের প্রেমকে আরও গভীর করে তোলে। মানুষ যেমন ভালোবাসে, এটা যেমন তার বৈশিষ্ট্য, তেমনি মানুষের মধ্যে ভক্তিভাবও থাকে। আবার মানুষের মধ্যে সংশয়, সন্দেহ, দ্বিধাও থাকে। এসব কিছু নিয়েই মানুষ সুন্দর। অসুন্দর কেবল মানুষের মধ্যকার ঘৃণা আর সহিংসতা।

লেখক: চিকিৎসক

* মতামত লেখকের নিজস্ব