ক্ষমতা কেন মিথ্যা বয়ান তৈরি করে? 

ক্ষমতা কেন মিথ্যা বয়ান তৈরি করে? কারণ, সে তার পূর্ববর্তী বয়ানকে মুছে ফেলে নিজের নিরাপত্তাহীনতাকে আড়াল করতে চায়। ক্ষমতা জানে তার বিলয় আছে কিন্তু ক্ষমতাবান জানে না কিংবা না জানার ভান করে। নতুন বয়ান এক ধরনের ভান। তার মানে এই নয়, এটা থেমে যাবে, এটা চলবে। ইতিহাস এই বয়ান তৈরির মধ্য দিয়ে ক্ষমতার দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। কিন্তু মানুষ তাকে অতিক্রম করতে চায়। মানুষের ইতিহাস তার দুর্বলতাকে অতিক্রম করার ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধ একটি ক্ষমতার নাম, একটি সংহত চিহ্ন। এর মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছে এবং এর ক্ষমতা যে চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত তা ধারণ করে একটা জাতির অস্তিত্ব। সেগুলি আমরা জানি, আবার বলি, সেগুলি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র। এই যে মূলনীতি তা জাতির সামগ্রিকতাকে প্রকাশ করলেও এর অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের রূপ হচ্ছে ভিন্ন বয়ান। এই ভিন্ন বয়ান একটা নয়, বহু। তবে মোটাদাগে দুটি। একটি পশ্চাদপদ, আর একটি প্রগতিশীল।

পশ্চাদপদ বয়ানের মূল চালিকা শক্তি ধর্ম। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলি ইহজাগতিক। ফলে এই বয়ান পরস্পর বিপ্রতীপ। স্বাধীন বাংলাদেশ যার অভ্যুদয় ঘটেছে ইহজাগতিক চেতনার ভিত্তিতে, তা স্বাধীনতার পর বিভক্ত হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের সময়ও ছিল, কিন্তু তা জয়ী হতে ব্যর্থ হয় কিন্তু তার বিলয় ঘটে না। এই পরাজিত শক্তিই বিপরীত শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থেকে যায়।

প্রগতিশীল অংশের নতুন বয়ান হচ্ছে বিদ্যমানতাকে ভেঙে আরও সুষম সমাজ তৈরি করা। সমাজতন্ত্র ছাড়া আর সব মূলনীতিগুলি একটা শোষণমূলক ব্যবস্থায় আটকে থাকে, ফলে তাকে অতিক্রম করা বিকাশের একটা দাবি। ফলে জাতীয়তাবাদের গণ্ডি ছাপিয়ে তা আন্তর্জাতিক হতে চায়। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের হয়ে উঠতে চায়, ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার দিকে যাত্রা করতে চায় এবং সমাজতন্ত্র কম্যুনিজমের দিকে।

ফলত, একটা রাষ্ট্রে তিনটি শক্তি তিনরকম বয়ান তৈরি করে। কিন্তু বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে কোন স্তরকে ছাপিয়ে যাওয়া যায় না, তাকে অতিক্রম করতে হয় মীমাংসা করে। এজন্য যে কোন সময় দুটি শক্তিই পরস্পর মুখোমুখি থাকে। যেমন বাংলাদেশ এখন সাম্প্রদায়িক শক্তির কব্জায়, সুতরাং এর বিরুদ্ধে লড়াই করবে অপর দুই শক্তি অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ও একে অতিক্রম করতে চাওয়া প্রগতিশীল অংশ। এটাই দ্বন্দ্বের নিয়ম।

সামাজিক দ্বন্দ্বকে শনাক্ত করতে না জানলে তার মীমাংসার পথ পাওয়া যায় না। কারণ দ্বন্দ্বই পরবর্তী ধাপে যাওয়ার মাধ্যম। কার সঙ্গে লড়াই এটা না জানলে লড়াইটা হয় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে তা হলো একটি পশ্চাদপদ সাম্প্রদায়িক শক্তি, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধসহ অন্যান্য প্রগতিশীল অংশ।

সাম্প্রদায়িক শক্তির পরাজয় ছাড়া পরবর্তী ধাপে বাংলাদেশ পা ফেলতে পারবে না। মনে রাখতে হবে বিকাশ সোজা পথে চলে না, এর গতি প্রায়ই সর্পিল। বাংলাদেশ এখন এই গতির বাঁকা অংশে আটকে গেছে। এই আটকে যাওয়াও গতির নিয়মের অংশ। কিন্তু প্রগতিশীল অংশের কাজ হচ্ছে সচেতন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাকে পরাজিত করা এবং পরবর্তী ধাপে পা ফেলা। শুধু পা ফেলা তাকে সংহত করার কাজে শক্তভাবে লেগে থাকা। এই কাজগুলি আর কিছু নয়, একটি শোষণমুক্ত সুষম সমাজ নির্মাণ।

লেখক: ঔপন্যাসিক

* মতামত লেখকের নিজস্ব