ঢামেক শিক্ষার্থী নন্দিনীর মৃত্যু
মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা, উদ্বেগে সহপাঠীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭:৫২, ৭ অক্টোবর ২০২৫
পূজা উদযাপনে ঝিনাইদহে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মেধাবী ছাত্রী নন্দিনী রানী সরকার। গত রবিবার (৫ অক্টোবর) ভোরে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
নন্দিনীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও ঢামেক সহপাঠীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করছেন, প্রকৃত কারণ বের হয়ে আসছে না।
সহপাঠীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্বেগের পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তারা আগামী বৃহস্পতিবার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি দান ও মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনের দাবিতে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে।
কিভাবে মারা যান নন্দিনী
অভিযোগ উঠেছে, পূজায় মদপানের কারণে নন্দিনী মারা গেছেন। কিন্তু পুলিশ বলছে, শুরুতে পরিবার মদপানের কথা জানালেও এখন আর কেউ মুখ খুলছেন না। বান্ধবীদের সঙ্গে মদপান করেছেন- বলা হলেও নন্দিনীর সঙ্গে আসলে কারা ছিল, কে মদ সরবরাহ করেছে বা অন্যরা মদপান করলেও তারা কেন অসুস্থ হলেন না-এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর মিলছে না। নানাবাড়ির লোকজন এবং এলাকাবাসীও এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। তবে কী ধরনের মদপান করে তার মৃত্যু হয়েছে ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর তা জানা যাবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শৈলকুপা থানার ওসি মাছুম খান বলেছেন, এ ঘটনায় থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। নন্দিনীর মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তবে তার নানাবাড়ির আত্মীয় স্বজন নতুন করে কোনো তথ্য দিচ্ছে না। এলাকাবাসীও এ নিয়ে মুখ খুলছে না। তবে যারা মদপানের সময় নন্দিনীর সঙ্গ যারা ছিল তাদেরকে শনাক্তের চেষ্টা করছি। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
এদিকে নন্দিনীর মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার পর তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের গিলন্ডে যান সাংবাদিকরা। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মেয়ের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি নন্দিনীর বাবা অনিল সরকার।
দরিদ্র পরিবারের মেয়ে নন্দিনী
গেল জানুয়ারিতে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেলের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় ১৩৩তম স্থান অর্জন করেছিলেন নন্দিনী রানী সরকার (১৮)। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) ভর্তির সুযোগ পান তিনি। ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে দরিদ্র পরিবারের হাল ধরবেন।
বাবা অনিল চন্দ্র সরকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালান। এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পাওয়ার পর নন্দিনীর পরিবারে বয়ে যায় খুশির হাওয়া। তবে সেই আনন্দের সঙ্গে ছিল দুশ্চিন্তাও। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালানো অনিল কীভাবে মেয়েকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাবেন? সে সময় সংবাদপত্রে নন্দিনীর সাফল্যের কথা প্রকাশ হলে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। তবে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নযাত্রার শুরুতেই থেমে গেলেন মেধাবী নন্দিনী।
উদ্বেগের ৫ কারণ সহপাঠীদের
নন্দিনীর মৃত্যুতে তার ঢামেকের কে-৮২ ব্যাচের সহপাঠীরা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা ইন্সটাগ্রামে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সেখানে বলা হয়েছে- ‘কে-৮২ ব্যাচের একজন সদা হাস্যোজ্জ্বল ও মেধাবী সহপাঠীকে আমরা হারিয়েছি। তার মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকপ্রকাশ করছি, তবে তার মৃত্যু সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গুজব নিয়ে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও হতবাক। নন্দিনীর আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত, তার এই অকালপ্রয়াণ আমরা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোভাবেই সমাধান সৃষ্টি করছে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহপাঠীরা সন্দেহের বেশকিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন-
১. গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে মদ্যপানকে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তার সঙ্গীদের কোন তথ্য সামনে আসছে না যা সংশয় এর জায়গা তৈরি করে।
২. যদি এলকোহল পানে মারা গিয়ে থাকে এলকোহলের সোর্স কে? ঢাকা মেডিকেলের একটা ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে, যাকে আমরা চিনি একজন অত্যন্ত ভালো নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে, যে জীবনসংগ্রাম করে নিজ পরিবারের অবস্থা পরিবর্তন করতে চেয়েছিল সে এই কাজ করবে নিজ ইচ্ছায় এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
৩. তার পরিবারের সদস্যগণ কর্তৃক কোনো জোরালো সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান এর প্রতি অনীহা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করছে বলে আমরা মনে করি।
৪. যে নন্দিনী চান্স পাওয়ার পর থেকে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ওর পুরো পরিবারের টেক কেয়ার করে আসছিল, এই ঘটনার পর তার পরিবার স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে উল্টো মামলা করার হুমকি দৃষ্টিকটু।
৫. বিভিন্ন মাধ্যমে এটা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে যে, ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটার সত্যতা উদঘাটন হওয়া দরকার। নন্দিনীর মৃত্যুর পূর্ববর্তী দুইদিনে তার অবস্থান সম্পর্কে কখনো মামাবাড়ি আবার কখনো চাচারবাড়ি বলে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে প্রতিকূলে নিয়ে যাচ্ছে।
সহপাঠীরা আরো লিখেছেন, ‘তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের ভিন্নমত ও চিকিৎসাসংক্রান্ত নিরপেক্ষ তথ্য না আসা পর্যন্ত, অপ্রমাণিত বা বিকৃত খবর প্রচার করা উচিত নয়। আমরা সবাইকে বিনীত অনুরোধ করছি, যথাযথ ডাক্তারি প্রতিবেদন ও প্রশাসনিক তদন্তের বাইরে কোনোকিছুই প্রচার না করার জন্য। দরকার পরলে তার ময়নাতদন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করার দাবী জানাচ্ছি। আমরা তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য দ্রুত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জোরদার দাবি জানাচ্ছি এবং এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।’
জড়িতদের শাস্তি চেয়ে মানববন্ধনের ডাক সহপাঠীদের
ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘জার্নালিস্টস উইথ ডিএমসি’ নন্দিনীর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ডেকেছে।
আজ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) এই গ্রুপে বলা হয়-
`আসসালামু ওয়ালাইকুম। আমাদের ব্যাচমেট নন্দিনী রানী সরকারের অকালপ্রয়াণে পুরো ডিএমসি শোকাচ্ছন্ন। তার মৃত্যুর সঠিক তদন্ত ও এর সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে আমরা কে-৮২ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আগামী বৃহস্পতিবার ৯ অক্টোবর দুপুর ১২ টায় মিলন চত্বরে একটি মানব বন্ধনের আয়োজন করেছি। নন্দিনীর জন্য যথার্থ ন্যায়বিচার চাওয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রত্যেক ব্যাচ এর সকলে শিক্ষার্থীর কর্তব্য। তাই আমরা আশা করছি সকলে উপস্থিত থেকে আমাদের দাবি ও মানববন্ধনকে আরো জোরদার করবেন।‘
